তাজমহলের নিচে সত্যিই কি রয়েছে কোনো সুড়ঙ্গ? রহস্য দীর্ঘদিনের

১৬৩১ সাল। দিনটি ছিল ১৭ জুন। মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরের মাটিতে কাতরাচ্ছেন এক নারী। দেখেই মনে হচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা। প্রায় ৩০ ঘণ্টা ধরে প্রসববেদনার যন্ত্রণা সহ্য করছেন তিনি। নাড়ি অতি ক্ষীণ; কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এমন সময় হাজির হলেন শাহেনশা। প্রিয়তমা পত্নীর এমন অবস্থা কি করে সহ্য করবেন তিনি? এখনও যৌবনের আলো চলে যায়নি শরীর থেকে। সেই দুশ্চিন্তা অবশ্য দেখতে পেলেন না বেগম সাহেবা। কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েই চিরতরে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। মুখ কালো করে অসে পড়লেন বাদশাহ শাহজাহান। সামনেই, প্রিয়তমা মুমতাজ মহল শেষ নিদ্রায় শুয়ে আছেন…

ঠিক এই দিনটি থেকেই শুরু হয়েছিল একটি স্বপ্নের জন্মবৃত্তান্ত। যমুনা নদীর ধারে শ্বেতমর্মর সৌধ তৈরি করে নিজের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন বাদশাহ শাহজাহান। যত অর্থ লাগে লাগুক; এই সৌধ যেন সকলের থেকে সেরা হয়। ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল— দীর্ঘ ২১ বছর ধরে তৈরি হল সেই স্থাপত্য। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশায় ঘিরে ফেলা হল মুমতাজ মহলের চিরনিদ্রার জায়গা। তৈরি হল ‘তাজমহল’। ভারত তথা গোটা পৃথিবীর বিস্ময়, ভালোবাসার প্রতীক। 

প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ভিড় করেন তাজমহলের আঙিনায়। প্রতিটা গম্বুজ, প্রতিটা কোণায় যেন সেই নিপুণতার ছাপ। কত ধৈর্য ধরে, তিলে তিলে তৈরি হয়েছে এই বিরাট বিস্ময় - ভাবতেও অবাক লাগে। তবে কেবলই কি সৌন্দর্য নিয়েই থেমে আছে তাজমহল? তা তো নয়। এই সৌন্দর্যের ভেতরেই ফুটে বেরোচ্ছে অপার রহস্য। প্রাচীন ইতিহাসের পরশ যার ছত্রে ছত্রে লেগে আছে, সেখানে কি একটুও আবডাল নেই? বিভিন্ন সময় তাজমহলের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে এরকম অনেক কিছুই নজরে পড়েছে পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের। আর সেইসবই বারবার মনে করিয়ে দেয় - এই ইতিহাসের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে আরও কিছু ইতিহাস… 

তাজমহলের ভেতর ঢুকলেই নজরে আসবে দুটো সমাধি। মার্বেল পাথরের ওপর অপূর্ব কারুকাজ করা সেই সমাধি দুটি যে কাদের, সেটা নতুন করে বলে দিতে হয় না। ঘরের ঠিক মাঝখানে শায়িত আছেন মুমতাজ মহল; তাঁর পাশেই স্বয়ং বাদশাহ শাহজাহান। বাদশাহের সমাধি দেখলে একটু যেন খটকা লাগে। যেন এই সমাধিটি কিছু পরে স্থাপিত করা হয়েছে। এবং সেই অনুমান সত্যি। বন্দি থাকাকালীন বৃদ্ধ শাহজাহান মারা গেলে, তাঁর পুত্র ও তৎকালীন বাদশাহ ঔরঙ্গজেব মুমতাজের পাশেই তাঁকে দাফন করে। প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র মুমতাজেরই সমাধি থাকার কথা ছিল। তবে এর বাইরেও উঠে আসে আরও একটি প্রশ্ন। ওই দুটি সমাধিতে কি সত্যিই শায়িত আছেন বাদশাহ এবং তাঁর বেগম? 

দীর্ঘ গবেষণার পর ঐতিহাসিকরা ওই দুটি সমাধিতে কোনো দেহাবশেষ খুঁজে পাননি। অর্থাৎ, একরকম ফাঁকাই আছে ওগুলো। এমন জিনিস তৈরি করার অর্থ কী? তাহলে তাঁদের আসল সমাধি কোথায়? ঘাবড়ানোর দরকার নেই; সমাধি দুটি তাজমহলেই আছে। ওই বিশেষ ঘরের নিচেই বেসমেন্টে রয়েছে আরও একটি ছোট্ট কুঠুরি। আর সেখানেই রয়েছে মুমতাজ আর শাহজাহানের প্রকৃত সমাধি। এর কারণও সহজেই অনুমেয়। বাদশাহ এবং তাঁর প্রিয়তমা বেগম যাতে শান্তিতে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারেন, সেইজন্যই এমন বন্দোবস্ত করা হয়েছে।   

আরও পড়ুন
৩ লক্ষ দেশলাই জুড়ে তৈরি তাজমহল, গিনেস রেকর্ডের দাবিদার কৃষ্ণনগরের তরুণী


না, রহস্য এখনও শেষ হয়নি। তাজমহলে ঘোরাঘুরি করলে আরও কিছু জিনিস আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। তাজমহলের মূল সৌধটি যে লাল পাথরের মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে, সেখানে চোখে পড়বে একটি রেলিংঘেরা জায়গা। কাছে গেলে মনে হবে, বেশ বড়ো একটা সুড়ঙ্গের মুখ। শুধু ওই মুখটাই দেখতে পাবেন; ভেতরে কী রয়েছে, কোথায় যাচ্ছে সুড়ঙ্গটি সেসব জানার উপায় নেই। কারণ, মুখটি অত্যন্ত সাবধানে বন্ধ। আর তার ওপরে পড়ে আছে বেশ কিছু খুচরো পয়সা। ঠিক যেমন কোনো মন্দিরের প্রণামীর থালায় বা বিগ্রহের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কী আছে ওখানে? 

অবশ্য এটাই একমাত্র সুড়ঙ্গের মুখ নয়। তাজমহলের মূল সৌধের ভেতর প্রবেশ করলে এরকম আরও একটি সুড়ঙ্গের বন্ধ মুখ দেখতে পাবেন। এটিও রেলিং দিয়ে ঘেরা; সঙ্গে লেখা সাবধানবাণী- ‘এখানে থামবেন না। ছবি তুলবেন না’। এমন গোপনীয়তা কেন? তাহলে কি বাদশাহ-বেগমের প্রকৃত সমাধি ছাড়াও, বেসমেন্টে আরও কিছু আছে? প্রবাদ বলে, তাজমহলের নিচে একটি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ রয়েছে। রয়েছে দীর্ঘ একটি বেসমেন্ট; যেখানে বেশ কিছু বন্ধ ঘর রয়েছে। এটা কি নিছকই প্রবাদ, না সত্যি? সুড়ঙ্গের বন্ধ মুখ আর শাহজাহান-মুমতাজের প্রকৃত সমাধি ছাড়া আর কিছুই জানা যায়নি।

আরও পড়ুন
তাজমহলের দেওয়ালে ক্যালিগ্রাফি তাঁরই; পাঞ্জাবের গ্রামে ধুঁকছে বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর শেষ চিহ্ন

এখানে না থেমে যাওয়া যাক একটি ছবির প্রসঙ্গে। ১৯৭৪ সালে মারভিন মাইলস নামের এক আমেরিকান স্থপতি যমুনা নদীর ধার থেকে তাজমহলের একটি ছবি তোলেন। সেখানে স্পষ্ট দেখা যায়, মূল সৌধের ঠিক নিচের মঞ্চের গায়ে একটি ছোট্ট আয়তাকার খোপ। আর তা বন্ধ রয়েছে কাঠের দরজা দিয়ে। এই খোপের গুরুত্ব কী? তাহলে কি এটি নিচের সুড়ঙ্গে যাওয়ার আরও একটি গোপন দরজা? এই খবরটি তখনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর চাঞ্চল্যও তৈরি হল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওই কাঠের দরজা সরিয়ে ইট দিয়ে ওই রাস্তাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এত তৎপরতা কেন? কী ছিল নিচে? কোথায় যাচ্ছিল রাস্তাটি? 

নানা সময় এই প্রশ্নটি উঠে এসেছে আমাদের সামনে। কিছু জনের দাবি, তাজমহলের নিচে যে সুড়ঙ্গ আছে, সেটি সোজা চলে গেছে আগ্রা দুর্গে। সেই আগ্রা দুর্গ। যেখানে জীবনের শেষ বছরগুলো বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছিলেন শাহজাহান। রাতে যখন পূর্ণিমার আলো তাজমহলের ওপর পড়ত, তখন আগ্রা দুর্গের জানলা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখতেন বৃদ্ধ বাদশাহ। আগ্রা দুর্গ আর তাজমহলের মধ্যে গুপ্ত সুড়ঙ্গ থাকার উদ্দেশ্যটাই বা কী ছিল? এখনও এসব কেবল ধারণা হয়েই আছে। আগ্রা দুর্গের নিচেও একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে বটে; কিন্তু সেটি বন্ধ। দরজা কবে খুলবে, আর রহস্য উদঘাটন হবে, সেটাই ভাবছেন কৌতূহলীরা। আর এই আলো-আঁধারির মধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে আছে তাজমহল। যমুনার ধারে ভালোবাসার মর্মর মূর্তি হয়ে… 

আরও পড়ুন
তাজমহল, এমনকি লালকেল্লাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন নটবরলাল

তথ্যসূত্র – 

১) ‘Secret Underground Zone of Taj Mahal’, Praveen Mohan Video
২) ‘রহস্যময়ী তাজমহলের অজানা কিছু তথ্য’, ডেইলি বাংলাদেশ
৩) ‘তাজমহল : কালের কপোল তলে একবিন্দু জল’, শাকিব মুস্তাবি, রোর বাংলা 

Powered by Froala Editor

More From Author See More