কঙ্গো নদীর রহস্যময় দৈত্য— বাস্তব নাকি কল্পনা?

উনিশ শতকের শেষের দিক। কঙ্গোয় ঔপনিবেশিক আধিপত্য কায়েম করেছে বেলজিয়াম। ফলে, ইউরোপীয় সাহেবদের আনাগোনা লেগেই থাকত কঙ্গোতে। কেউ আসতেন এই নতুন দেশ পরিভ্রমণ করতে, কেউ আবার প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধানে। কঙ্গো নদীই ছিল, সে-সময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। তবে এই গল্প কঙ্গোর (Congo) ইতিহাস কিংবা ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে নয়, বরং এক অদ্ভুত প্রাণীর। যার আয়তন পূর্ণবয়স্ক হাতির দ্বিগুণ। তবে পায়ের আয়তন খুবই ছোটো; সঙ্গে অনেকটা জিরাফের মতো দীর্ঘ পেশিবহুল গলা।

মোকেলে এমবেমবে (Mokele Mbembe)। কঙ্গোর আদিমতম বাসিন্দা নাকি তারাই। উনিশ শতকের শেষে একদল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের হাত ধরেই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এই অদ্ভুত দর্শন প্রাণীর কথা। একবার, দু-বার নয়, ভিন্ন ভিন্ন দেশের একাধিক অভিযাত্রী, একাধিকবার এই রহস্যময় প্রাণীর দর্শন পাওয়ার দাবি করেছেন। 

তবে মোকেলে এমবেমবের ইতিহাস আরও পুরনো। সাহেবদের ঘাঁটি তৈরির বহু আগে থেকেই কঙ্গোর স্থানীয় আদিবাসীদের লোককথায় বার বার উচ্চারিত হয়েছে এই দৈত্যাকার প্রাণীর নাম। কোনো লোককথা অনুযায়ী তার নাম ‘মোকেলে এমবেমবে’ আবার কোথাও সে পরিচিত ‘লিঙ্গালা’ নামে। কঙ্গোর স্থানীয় ভাষায় ‘লিঙ্গালা’ কথাটির অর্থ ‘নদী প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে যে’। কখনও তাঁর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে প্রাচীন কোনো প্রাণীর রূপে, আবার কখনও সে হয়ে উঠেছে অলৌকিক জীব বা উপদেবতা হিসাবে। অনেকটা ব্যুনিপ কিংবা ইয়েতির মতোই। কিন্তু সত্যিই কি এই দৈত্যের উপস্থিতি আছে কঙ্গোয়?

কঙ্গোর লোককথায় এই প্রাণীর বর্ণনা থেকেই আন্দাজ পাওয়া যায় মোকেলে এমবেমবের আয়তন সম্পর্কে। এই বিপুল আয়তনের কোনো প্রাণী থেকে থাকলেও নদীর জলে আদৌ কি বছরের পর বছর তার গা ঢাকা দিয়ে থাকা সম্ভব? পাশাপাশি তার দেহের গড়ন এবং চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে কাছাকাছি যে প্রাণীটির মিল পাওয়া যায়, তা হল ব্রন্টোরোসোরস। আজ থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগেই যা অবলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। সবমিলিয়ে আক্ষরিক অর্থে এমন প্রাণীর অস্তিত্বের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে অনেকেরই বিশ্বাস, এই প্রাণী আসলে ডাইনোসরেরই বংশধর। আবার কেউ বলেন, এই প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে মানুষের অত্যাচারেই।

যুগ যুগ ধরে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসাবে দেখানো হয়, বহু পুরনো অতি-ঝাপসা কিছু ফটোগ্রাফ ও ভিডিও। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মযাজক ইউজিন থমাসের বক্তব্যকে প্রামাণ্য হিসাবে ধরে নেন তাত্ত্বিকরা। ১৯৫৫ সাল থেকে থমাস ধর্মপ্রাচরক হিসাবে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন কঙ্গোতে। ১৯৫৯ সালে নাকি লেক টেলির কাছে একটি মোকেলে এমবেমবে শিকার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেই অভিযানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন স্থানীয় বেঙ্গোম্বে উপজাতির মানুষরা। এই অদ্ভুত প্রাণীর মাংস খাওয়ার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন থমাসের অধিকাংশ সঙ্গী। তার কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু। তবে মোকেলে এমবেমবের মাংস স্পর্শ না করায় প্রাণ বেঁচেছিল তাঁর। 

বিশ শতকে তো বটেই, আজও রীতিমতো প্রাগৈতিহাসিক রহস্যময় এই দৈত্যের খোঁজ চলছে কঙ্গো নদীর অববাহিকায়। এমনকি বছর দুয়েক আগেও কঙ্গোর তীরে তিন আঙুল বিশিষ্ট এক রহস্যময় প্রাণীর পায়ের ছাপ পেয়েছিলেন কিছু অভিযাত্রী। নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মোকেলে এমবেমবে-তত্ত্ব। কিন্তু সত্যিই এই প্রাণী আছে কিংবা কস্মিনকালে আদৌ ছিল কিনা, সেই রহস্য থেকেই গেছে… 

Powered by Froala Editor

Latest News See More