খালি গায়ে দৌড়ে বেড়ান পথে-পথে, কেনিয়ার রহস্যময় নাইট রানারদের গল্প

“রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে…”

হ্যাঁ, এই ভারতের বুকে একসময় রাতবিরেতেও ছুটে বেড়াত রানাররা। চিঠি পৌঁছে দিত বাড়ি বাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারতে রানারদের দিন শেষ হয়েছে বহুযুগ। এমনকি বর্তমানে প্রযুক্তির দৌলতে বন্ধ হতে বসেছে চিঠি লেখালিখির চল-ও। তবে ভারত থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে আজও হঠাৎ করেই দেখা পেতেন পারেন রানারের। অবশ্যি বাড়ি বাড়ি সুখ-দুঃখের খবর পৌঁছে দেওয়া তাঁদের কাজ নয়। বরং, বাড়ির আশেপাশে তাঁদের উপস্থিতি রীতিমতো ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে সাধারণ মানুষকে। 

নাইট রানার (Night Runner)। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত তাঁরা। কেনিয়ার (Kenya) বুকে গভীর রাতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ছুটে বেড়ান তাঁরা। পরিচয় গোপন করতে সারা মুখে মেখে থাকেন ভস্ম। সেইসঙ্গে করে বেড়ান আশ্চর্য সব কার্যকলাপ। বাড়ির টিনের ছাদে ঢেলা কিংবা বালি নিক্ষেপ, তারস্বরে রহস্যময় মন্ত্রোচ্চারণ, বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে যাওয়া বা বেল বাজানো— সবরকমের দস্যিপনাই রয়েছে সেই তালিকায়। কাজেই রহস্যাবৃত এই দৌড়বিদদের নিয়ে যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে একাধিক কিংবদন্তি, লোককথা। আগ্রহের পরিবর্তে মানুষের মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছে ভয়। 

অনেকে নাইট রানারদের এই দাপাদাপিলে স্রেফ রাতবিরেতের উপদ্রব বলে মনে করলেও, কেউ কেউ বিশ্বাস করেন খোদ শয়তানের অবতার নাইট রানাররা। নাইট রানারদের সাক্ষাৎ পেয়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা কিছুদিন পরেই মৃত্যু হয়েছে— এমন কিংবদন্তিও ছড়িয়ে রয়েছে কেনিয়াজুড়ে। আবার অনেকের অভিমত, নাইট রানাররা নাকি স্বয়ং ঈশ্বরের দূত। পৃথিবীর মানুষকে রক্ষার জন্য তাঁদেরকে নিয়োগ করেন ভগবান। আবার পারিবারিক সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে, বংশ পরম্পরায় নাইট রানারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কিছু মানুষ— এমন কথাও ঘুরে ফিরে বেড়ায় কেনিয়ায়। এ-তো গেল লোককথার গল্প। কিন্তু আদতে কারা নাইট রানার? সে-ব্যাপার কী মতামত গবেষকদের?

মজার বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত নাইট রানারদের নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কেবলমাত্র একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রের লেখক টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ কেনিয়ার অধ্যাপক টম কোয়ানিয়া। তাঁর কথায়, আফ্রিকার আদিবাসী সংস্কৃতিকে কোনোদিনই সেভাবে প্রাধান্য দেয়নি শ্বেতাঙ্গরা ঔপনিবেশিকরা। কোনোরকম উদ্যোগ নেননি সংরক্ষণের। ফলে, যত সময় এগিয়েছে তত বিকৃত হয়ে সেই সংস্কৃতি। নাইট রানাররাও হয়তো এমনই বিকৃত কোনো সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাঁর কথায়, নাইট রানাররা কোনো বিশেষ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ নয়। সমাজের সমস্ত অর্থনৈতিক শ্রেণির, সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকেই নাইট রানারের ভূমিকায় দেখা গেছে কখনো না কখনো। এমনকি শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য নয়, বরং স্থানীয়দের নিছক ভয় দেখানোর জন্যই এমন আশ্চর্য কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বেড়ায় তারা। 

১৯০১ সালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রের পর আর দ্বিতীয় কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি নাইট রানারদের নিয়ে। তার একটি কারণ হল, তথ্যের অভাব। পাশাপাশি নাইট রানারদের দেখা পাওয়াও রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। বর্তমানে ক্রমে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায়, কমে এসেছে নাইট রানারদের তাণ্ডবও। 

তবে ২০১৩ সালে নাইট রানারদের সম্পর্কে প্রথম প্রকাশ্যে বয়ান রাখেন, কেনিয়ার জ্যাক সাংগো নামের এক ব্যক্তি। এও দাবি করেন তিনি নাকি ‘কেনিয়া নাইট রানারস অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি গুপ্ত-সংগঠনের সভাপতি। তাঁর কথা অনুযায়ী, যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন নাইট রানাররা। তাঁরা নিছক মজা করলেও, জ্ঞানত কারোর কোনো ক্ষতি করেননি। উল্টে তাঁদের উপস্থিতি বাড়তি নিরাপত্তা প্রদান করেছে স্থানীয়দের। রাতের বেলায় বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে তাঁদের। 

এখানেই শেষ নয়। নাইট রানিং-কে জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেন তিনি। নাইট রানারদের স্বঘোষিত সভাপতির এই বয়ানে প্রাথমিকভাবে কেনিয়া-জুড়ে সাড়া পড়ে গেলেও, কিছুদিনের মধ্যেই থিতিয়ে যায় উত্তেজনা। এমনকি সংবাদমাধ্যমে বাড়তি কোনো তথ্য প্রদান করতেও রাজি হননি তিনি। কেবলমাত্র জানিয়েছিলেন, তিনি নিজেও একজন নাইট রানার। রীতিমতো অনুশীলন করেন নাইট রানিং-এর। অবশ্য তাঁর এই বক্তব্যকে পাগলের প্রলাপ বলেই মনে ধরে নেন একাংশ। কিন্তু সত্যিই কি এইসব কথা তাঁর সম্পূর্ণ মন-গড়া, বানানো কাহিনি? 

না, সেই উত্তর মেলেনি আজও। তবে স্থানীয়রা তো বটেই, নাইট রানার দর্শনের দাবি করেন বিদেশি পর্যটকরাও। কেনিয়া ছাড়িয়ে বর্তমানে নাইট রানাররা ঢুকে পড়েছে ইউরোপের নানান গল্প-উপন্যাসেও। সবমিলিয়ে রহস্যময় এই দৌড়বিদদের নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য মায়াজাল।

Powered by Froala Editor