ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। কাজ থেকে ফিরে দুই সন্তান আশা ও ব্রায়ানকে পড়াতে বসেছিলেন হ্যারল্ড। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎবিভ্রাট। গোটা অঞ্চল ডুবে যায় অন্ধকারে। ফলে, অন্যান্য দিনের তুলনায় খানিক আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে আসেন হ্যারল্ড। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ বিদ্যুৎ আসার পর সন্তানদের শয়নকক্ষে গিয়ে দেখেও এসেছিলেন, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তারা। তবে পরবর্তী কয়েকঘণ্টার মধ্যেই যে তাঁর শিশুকন্যার জন্য তোলপাড় পড়ে যাবে শহরজুড়ে, তা কে-ই বা জানত।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার শেলবি থেকে রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয় মাত্র ৯ বছর বয়সি কিশোরী আশা। ২৩ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর আজও যে রহস্যের মীমাংসা করতে পারেনি স্থানীয় পুলিশ, স্টেট ইন্টেলিজেন্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি গোয়েন্দা বিভাগ এফবিআই। কিন্তু কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল আশা (Asha Degree)?
সেদিন ভোর পৌনে ছ’টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠেছিলেন হ্যারল্ডের স্ত্রী অর্থাৎ আশা ও ব্রায়ানের মা ইকুইলা। প্রথমত ভ্যালেন্টাইন’স ডে, তার ওপর আবার হ্যারল্ড-ইকুইলার বিবাহবার্ষিকী। ফলে, অফিসে ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ইকুইলা। পাশপাশি সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বন্দোবস্তও যে করতে হবে। খাবার তৈরি করতে হবে তাদের জন্য। ঘরের কাজ গুছিয়ে সকাল সাড়ে ছটার সময় আশা ও ব্রায়ানকে ডাকতে তাদের ঘরে যান ইকুইলা। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রায়ান নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকলেও অনুপস্থিত আশা।
প্রাথমিকভাবে তাঁর মনে হয়েছিল, ঘুম থেকে উঠে আশা হয়তো স্নান করতে গেছে আশা। তবে গোটা বাড়িতে তাকে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে না-পেয়ে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বেরতে হয় ডিগ্রি দম্পতিকে। তবে লাভ হয়নি কোনো। গোটা শহরজুড়ে তল্লাশি চালালেও সন্ধান মেলেনি আশার। শেষ পর্যন্ত থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয় আশার নামে। সেদিন দুপুর নাগাদ তদন্ত শুরু করেন শেলবি পুলিশের শেরিফ।
শেরিফ আশার ঘরে পরীক্ষা করতে এসে প্রথম যে জিনিসটি আবিষ্কার করেন, তা হল শুধু আশা নয়, বাড়ি থেকে উধাও তার স্কুল ব্যাগও। সেইসঙ্গে তার পছন্দের বেশ কয়েকটি জামা-কাপড়। অন্যদিকে তার বিছানা থেকে উদ্ধার হয় একটি পশমের রহস্যময় গ্লাভস। এই গ্লাভস যে আশার নয়, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কোনো। কিন্তু কে এই গ্লাভসের মালিক?
উত্তর খুঁজতে গোটা অঞ্চলে কুকুর বাহিনীর সাহায্যে অনুসন্ধান চালায় পুলিশ। তবে অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তি তো বটেই, আশার পায়ের ছাপ ও গন্ধও চিহ্নিত করতে পারেনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুররা। অর্থাৎ বলতে গেলে নিজের বিছানা থেকে যেন আক্ষরিক অর্থেই উবে গিয়েছে আশা। এমনকি ইকাইরার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সকালে যখন তিনি ঘুম থেকে ওঠেন, তখন বন্ধ ছিল বাড়ির সমস্ত দরজা-জানালা। ফলে প্রশ্ন থেকে যায় কীভাবে বাড়ি থেকে বেরোল ছোট্ট কিশোরী? আর যদি অপহরণ করা হয়, তবে কোন পথে প্রবেশ করেছিল অপহরণকারী?
এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি কোনো। এরই মধ্যে, দিন দুয়েক বাদে ঘটে যায় আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। শেলবি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখা যায় আশাকে। পোস্টারে নিরুদ্দেশ হওয়া আশার ছবি দেখে তাকে চিনতে পেরেছিলেন স্থানীয় এক ট্রাক চালক। তবে তিনি গাড়ি দাঁড় করিয়ে আশাকে প্রশ্ন করতেই, ছুটে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যায় আশা। কয়েকদিন পর এই একই ঘটনা ঘটে স্থানীয় এক পাদ্রীর সঙ্গেও। মজার বিষয় হল, তাঁদের বর্ণনা অনুযায়ী আশার যে-যে পোশাক পরেছিল সে-সময়, সেগুলিও রহস্যময়ভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল আশার অন্তর্ধানের সঙ্গে। ফলে, তাঁরা যে আশাকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এমনকি পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে তল্লাশি চালিয়ে একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশ কিছু চকোলেটের প্যাকেট, আশার পেনসিল বক্স, রাবার-সহ একাধিক সামগ্রী খুঁজে পায় পুলিশ।
সেই শেষবারের জন্য দেখা গিয়েছিল আশাকে। এরপর আর কোনো সন্ধান মেলেনি তার। দীর্ঘ এক বছর ধরে তদন্ত চালালেও, শেষ অবধি হাল ছেড়ে দেয় স্থানীয় পুলিশ। এর বছর চারেক পর আশ্চর্য আকস্মিকভাবেই প্রকাশ্যে আসে রহস্যজনক এক তথ্য। ২০০৪ সালে কাউন্টি শেরিফের কাছে এক কারাবন্দি চিঠি লিখে জানান, আরেক বন্দি নাকি হত্যা করেছে আশাকে। এমনকি তার দেহ পুঁতে রাখা হয়েছে অরণ্যের একটি বিশেষ অংশে। সেখানে খনন করে কিছু হাড় খুঁজে পাওয়া গেলেও, ডিএনএ পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল সেগুলি আদতে কুকুরের হাড়।
২০১৩ সালে ডিগ্রি-দম্পতির আবেদনে, নতুন করে তদন্তের খাতা খোলে রাজ্য গোয়েন্দা এবং এফবিআই। আশার কৈশোরের ছবির ওপর ভিত্তি করে একাধিক প্রাপ্তবয়স্ক ছবিও তৈরি করে তারা। যা শেলবি শহর তো বটেই, গোটা নর্থ ক্যারোলিনাজুড়ে দেওয়ালে দেওয়ালে লাগানো হয়েছিল সেই পোস্টার। আপলোড করা হয়েছিল ইন্টারনেটেও। এমনকি আশা এবং তার অপহরণকারীদের খুঁজে দিতে পারলে ২৫ হাজার ডলার পুরস্কারও দেওয়া হবে— এমনটাও ঘোষণা করা হয়েছিল তদন্তকারী সংস্থারা। আশা-অন্তর্ধান সম্পর্কে আজও কোনো সঠিক তথ্য খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুঁদে গোয়েন্দারাও। খাতায়-কলমে সেই তদন্ত চলছে আজও। অন্যদিকে ২৩ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কন্যাসন্তানকে একদিন ফিরে পাওয়া যাবে, এই আশা নিয়েই বেঁচে রয়েছেন হ্যারল্ড-ইকাইরা।
Powered by Froala Editor