শ্রীদেবী থেকে শুরু করে সুশান্ত সিং রাজপুত— খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আত্মহত্যা বা রহস্যমৃত্যু সাধারণ মানুষের মধ্যে তোলপাড় তুলেছে বার বার। আজকের দিনেও সংবাদমাধ্যম হামেশাই চোখে পড়ে এ-ধরনের ঘটনা। তবে এহেন ঘটনা প্রথমবার ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসাবে রহস্যজনকভাবে প্রয়াত হয়েছিলেন এক মার্কিনি মডেল।
ভার্জিনিয়া ক্যারোলিন র্যাপে (Virginia Caroline Rappe)। ১৮৯১ সালের ৭ জুলাই শিকাগোয় জন্ম ভার্জিনিয়ার। বিশ শতকের শুরুর দিকে বিনোদন জগতে আত্মপ্রকাশ করেন ভার্জিনিয়া। প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেন বিভিন্ন মার্কিন বিজ্ঞাপনের মডেল হিসাবে। সেই সূত্র ধরেই পা দেওয়া বিনোদন জগতে। সৌন্দর্য ও অভিনয়ে সাবলীলতার কারণে অল্পদিনের মধ্যেই চলচ্চিত্র পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ভার্জিনিয়া।
১৯১৬-১৯২১— মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে সবমিলিয়ে প্রায় ১০টি নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন ভার্জিনিয়া। যদিও কেবলমাত্র ৫টি সিনেমাতেই অভিনেত্রী হিসাবে স্বীকৃতি পান তিনি। অন্যদিকে বাকি সিনেমাগুলির মুক্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভার্জিনিয়ার রহস্যমৃত্যু। কিন্তু কীভাবে প্রয়াত হলেন তিনি?
১৯১৬ সাল। অভিনেত্রী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর ভার্জিনিয়া শিকাগো থেকে চলে এসেছিলেন সান ফ্রান্সিসকোতে। এ-সময় মার্কিন পোশাক ডিজাইনার রবার্ট মস্কোভিজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রবার্ট ও ভার্জিনিয়া। তবে বছর কাটতে-না-কাটতেই পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় রবার্টের। এই ঘটনার পর বাধ্য হয়েই শহর পরিবর্তন করেন ভার্জিনিয়া। চলে যান লস অ্যাঞ্জেলিসে।
লস অ্যাঞ্জেলিসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পরিচালক ফ্রেড বালশোফারের। বলতে গেলে বালশোফারের হাত ধরেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা তাঁর। ‘প্যারাডাইস গার্ডেন’, ‘ওয়াইল্ড উইমেন অ্যান্ড টেম লায়নস’, ‘অ্যাডভেঞ্চারস’-এর মতো জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করেন ভার্জিনিয়া। এমনকি ‘অ্যাডভেঞ্চারস’ ছবিটির জন্য পেয়েছিলেন মরনোত্তর ‘বেস্ট ড্রেসড গার্ল ইন পিকচার’ পুরস্কার। তবে শুধু অভিনয়ের ক্ষেত্রেই নয়, বালশোফার বদলে দিয়েছিলেন ভার্জিনিয়ার ব্যক্তিগত জীবনকেও। তাঁর সূত্রেই ভার্জিনিয়ার আলাপ হয় প্রযোজক হেনরি লেহম্যানের সঙ্গে। ১৯১৯ সালে তাঁর সঙ্গেই দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জনপ্রিয় অভিনেত্রী।
ভার্জিনিয়া নতুন জীবনে সুখী হলেও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সুদিন। বিবাহের পর থেকেই একাধিক শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করেন ভার্জিনিয়া। এমনকি গর্ভপাতের পথেও হাঁটতে হইয়েছিল তাঁকে। এর মধ্যে ঘটে যায় আরও এক অদ্ভুত ঘটনা। ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। সেন্ট ফ্রান্সিস হোটেলে সেদিন আয়োজিত হয়েছে শ্রম দিবসের পার্টি। ভার্জিনিয়া ছাড়াও সেখানে হাজির ছিলেন হলিউডের বিশিষ্ট তারকারা। অবশ্য সেই পার্টিতে হাজির থাকলেও, বেশ কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে যান ভার্জিনিয়া। তারপর হোটেল থেকে উদ্ধার হয় তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ। শরীরের নিম্নাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ব্যাপার কী?
তদন্তে উঠে আসে, মূত্রাশয় ফেটে যাওয়া বা পেরিটোনাইটিসের কারণে মৃত্যু হয়েছে ভার্জিনিয়ার। তবে পাশাপাশি উঠে এসেছিল আরও একাধিক তত্ত্ব ও সম্ভাবনাও। অনুমান করা হয়, সিস্টাইটিস বা অবৈধ গর্ভপাতের জটিলতাই এই অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাঁকে। পাশাপাশি ভার্জিনিয়ার পরিচিত এক মাউড ডেলমন্ট দাবি করেন, সেদিন ফ্রান্সিস হোটেলে ভার্জিনিয়াকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছিলেন ফ্যাটি আর্বাকল নামের এক ব্যক্তি। তাঁর নির্যাতনেই ভার্জিনিয়ার মূত্রাশয় ফেটে যায় বলে অভিযোগ করেন মাউড।
এই অভিযোগের ভিত্তিতেই আদালতে ওঠে মামলা। গ্রেপ্তার করা হয় রসকো ফ্যাটি আর্বাকলকে। তৎকালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল ভার্জিনিয়া হত্যা-মামলা। যদিও শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ফ্যাটিকে নির্দোষ হিসাবে ঘোষণা করে মার্কিন আদালত। তবে ভার্জিনিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সম্পূর্ণভাবে বদলে গিয়েছিল হলিউড। যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে হলিউডে নৈতিকতা এবং মহিলাদের প্রতি সংযমের বিষয়গুলি মাথায় রেখে তৈরি করা হয় একাধিক নিয়মাবলি। শুরু হয় সচেতনতা বৃদ্ধির আন্দোলনও। সংক্ষিপ্ত কেরিয়ারে অভিনয় ছাড়াও পরোক্ষভাবে চলচ্চিত্র জগতের পরিকাঠামোকে দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ভার্জিনিয়া, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো।
Powered by Froala Editor