‘কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কল্যাণ করিয়া আড়াই মুঠা কাটিয়া লক্ষীপূজা হইয়া গিয়াছে...’ - গণদেবতা উপন্যাসে প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এক ছত্রে লিখে রেখে গেছেন এই উদ্ধৃতিটি। স্বাভাবিক ভাবেই, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কোনো কংক্রিটের শহরে বসে তরুণ প্রজন্ম যখন এই লাইন পড়বে, তখন তাদের মনে এই লাইনের অর্থ বোঝার কৌতূহল জাগতেই পারে। লেখক কার্তিক সংক্রান্তির দিনে কীসের কল্যাণে, কী কাটিয়া লক্ষীপূজোর কথা তুললেন?
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় গ্রাম-বাংলার এক প্রচলিত উজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী রীতির সংলাপ এখানে তুলে ধরেছেন। লেখক এখানে কার্তিক সংক্রান্তির দিনে এক লক্ষীপূজোর কথা বলেছেন এবং সংক্ষেপে সেই পুজোর বর্ণনাও বর্ণিত করেছেন। আসলে কার্তিক সংক্রান্তিতে অর্থাৎ অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিনে গাঁয়ের মানুষেরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত থেকে আড়াই মুঠা করে ধান কেটে, সেই ধানের সমষ্টি বাড়ির পবিত্রস্থানে রেখে লক্ষীরূপে পুজো করে। এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি, অদ্ভুত বিশ্বাস।
অঘ্রাণ মাস মানেই নবান্নের মাস। শ্রাবণের শুরুতে প্রবল বৃষ্টিপাতের দ্বারা, এ ধরণীর মাটি যখন গর্ভবতী হয়। অন্তত কৃষকেরা তখন সঠিক সময় বুঝতে পেরে, মাটিতে ছড়িয়ে দেয় ধানের বীজ। কয়েকদিন পর, দিগন্তের ক্ষেত বিদীর্ণ করে সবুজে-শ্যামলে-নীলিমায় সেই ক্ষেত ভরে ওঠে কানায় কানায়। কোজাগরীর চাঁদের আলো সেই ধরণীর ক্ষেতে এসে লাগলেই, সোনালি রং ধরে ধানের শিসে। কৃষকেরা বুঝে যায় এবার সুদিন আসছে, মুখে হাসি ফোটে তাদের, গোলাভরা ধান মানেই সমস্ত ঋণের অবসান। শুরু হয়ে যায় নবান্নের আয়োজন। কিন্তু তারও আগে অর্থাৎ কার্তিক সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে, অঘ্রাণের প্রথম দিনে তারা পালন করে মুঠ পুজো। অর্থাৎ তাদের ভাষায়, সংক্রান্তি তিথি অনুসারে এই মুঠো পুজো হল এ বাংলার প্রথম লক্ষীপুজো।
ক্ষেতের সোনালি ধান খামারের গোলায় তোলার আগে যাতে কোন বিপত্তি সৃষ্টি না হয়, তার জন্য প্রথমেই মা লক্ষীর পুজো শ্রদ্ধাভরে পালন করে কৃষকরা। অঘ্রাণের প্রথম সকাল, ভোরের কুয়াশায় ভিজে যায় মাঠ-ঘাট। আজও গাঁয়ের ক্ষেত-খামারে অপলক অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকে হয়তো জীবনানন্দের গাংচিল। গায়ে এসে লাগে ঠান্ডা হাওয়া। এদিন বেলা বাড়লেই কৃষকের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় মুঠপুজোর আয়োজন। সকালবেলা স্নান সেরে, পবিত্র সাদা পোশাক পরিহিত হয়ে, হাতের কাস্তেটি বাগিয়ে নিয়ে কৃষকেরা চলে যায় যে যার ক্ষেতে। তারপর ক্ষেতের এক কোণে আড়াই মুঠা ধান কেটে, ভক্তিভরে প্রণাম করে, সেই ধানের সমষ্টিকে মাথায় তুলে, বাড়ি ফেরার গন্তব্যে পা বাড়ায় নিঃশব্দে। নিজের বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালেই কৃষকের স্ত্রী অর্থাৎ বাড়ির গৃহবধূরা একটা কাঠের পিড়েতে তাদের দাঁড় করায়, তারপর মাটির মঙ্গলঘটের জল দিয়ে কৃষকের পা ধুইয়ে, নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয় কৃষকের পা। তারপর সেই গৃহবধূ ভক্তিভরে প্রণাম সেরে, মা লক্ষীকে সাদরে আহ্বান জানায় ঘরে। এবং অবশেষে সেই ধানের সমষ্টিকে বাড়ির পবিত্র স্থানে রেখে পুজো করে।
কালের নিয়মে হয়তো ক্ষয়ে গেছে এই প্রথার রেওয়াজ, হয়তো একদিন সম্পূর্ণই হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম হয়তো এই রীতি জানবেই না৷ আর সেদিনও হয়তো সেই প্রজন্ম, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’র ওই লাইনটুকু পড়ে জানতে চাইবে তার অন্তর্নিহিত অর্থ। হারালেও, এভাবে কিছু কিছু থেকে যায়। থেকে তো যায়ই...
