মনে ও মুখে এক হওয়ার থেকে বড় সাধনা আর নেই, তিনি বলেছিলেন। আর সেই এক হওয়া যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। বিশেষত, তা যখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে। বহু ধর্মপালনের এ-দেশে যিনি বহুত্বের প্রচার করবেন- জানাবেন, মত অনুযায়ী পথ পৃথক হলেও অন্তিম দর্শনে সকলই এক, তাঁকে অবশ্য কেবল তত্ত্বকথায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলে চলত না। শ্রীরামকৃষ্ণ তাই তত্ত্বে বাঁধা হয়ে থাকেনওনি। বরং আপনি আচরি ধর্ম জগতকে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি, পেরেওছিলেন।
আরও পড়ুন
পাঁচালির হাত ধরে ‘লক্ষ্মীবিবি’ ঢুকে পড়েন মুসলমানের ঘরেও
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ নাগাদ রামকৃষ্ণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর গুরুর নাম গোবিন্দ রায় (জানা যায়, পরে তাঁর নাম হয়েছিল ওয়াজেদ আলি খান)। শান্ত, ভক্তিমান এই মানুষটিকে কালীবাড়িতে দেখে, ঠাকুরের প্রতীতি হল যে, ইনি সাক্ষাৎ ভগবান লাভ করেছেন। তাই এঁর কাছে ইসলামে দীক্ষা নিয়ে, সেই ধর্মমতের শেষে কী আছে, তা দেখে নিতে চাইলেন তিনি নিজে। নিলেন দীক্ষা। এবং ইসলাম মতেই শুরু হল সাধন। সে-সময় হিন্দু দেবদেবীর দিকে তিনি তাকাতেন না। পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা খাবার খেলেন। একজন অ-হিন্দুর মতোই মন্দির সীমানার বাইরে এসে বাস করতেন। খাওয়া-পরা থেকে প্রার্থনা – সবকিছুতেই তিনি হয়ে উঠলেন একজন খাঁটি অ-হিন্দু। স্বামী নির্বেদানন্দ তাঁর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও আধ্যাত্মিক নবজাগরণ’ বইটিতে জানাচ্ছেন, ‘হিন্দু দেবদেবী –সংশ্লিষ্ট সমস্ত চিন্তা, দর্শন ও ভাবাবেগ তাঁর মন থেকে তখনকার মতো একেবারে লুপ্ত হল এবং তাঁর পবিত্র চিত্ত নিস্তরঙ্গ সরোবরের মতো ইসলাম ভাবের অন্তর্নিহিত সত্যের প্রতিফলনের জন্য প্রতীক্ষারত হয়ে রইল। তিনি ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করে চললেন, শ্রদ্ধাবান মুসলমান ফকিরের মতো নিয়মিতভাবে নামাজ পড়তে লাগলেন।’
চলল সাধন। তিন দিনের মাথায় এক গম্ভীরানন পুরুষের দর্শন হল তাঁর। ভক্তদের অনুমান, স্বয়ং মহম্মদের দেখা পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। এবং সেই দর্শনে নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের অনুভব পেলেন তিনি। এর আগে অদ্বৈতসাধনমার্গেও একই অনুভূতির স্তরে পৌঁছেছিলেন তিনি। অর্থাৎ, এই অদ্বৈত অনুভূতিই দুই ধর্মের সাধারণ ভূমি। তফাৎ শুধু পালনীয় আচরণবিধিতে। সে কথা রামকৃষ্ণ জানালেন, ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ধর্মমতে সাধন করেই।
সেই সময়ে তো বটেই, আজও রামকৃষ্ণের এই ধর্মাচরণের এক গভীর তাৎপর্য আছে। আজ দেশে দেশে বিভিন্ন মতাদর্শের পতন দেখা যায়, কারণ, তত্ত্ব ও ফলিতে কোনো মিল থাকে না। এমনকী ধর্ম নিয়ে আজ যে বিভাজন দেখা যায়, তার ভয়াবহতা রামকৃষ্ণের মতো দার্শনিক উপলব্ধি করেছিলেন বহু আগেই। বহুত্বের মধ্য দিয়ে একতার স্বরূপটি তাই তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে কখনও তত্ত্বের সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আটকে রাখেননি। আজ যে ভাবে বিভাজনের ন্যারেটিভ সযত্নে তৈরি হচ্ছে, তার কাউন্টার ন্যারেটিভ যেন রামকৃষ্ণ মানুষের হাতে তুলেই দিয়ে গিয়েছিলেন। আজও সমস্ত তত্ত্বগত উদারতা সত্ত্বেও এই যে বিভাজনের লতাপাতা ফনফনিয়ে উঠছে তার কারণ অবশ্যই তত্ত্বের সঙ্গে আচরণের বিস্তর প্রভেদ। তার কারণ, একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথাও থেকে গিয়েছে সংরক্ষণ। রামকৃষ্ণ তা আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, অ-হিন্দু পথে সাধনের জন্য তিনি ইসলামের পরে খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষিত হয়েছিলেন। কোনও ভেদাভদকে প্রশ্রয় দেননি। এই সংকীর্ণতা পেরোনো যে আজ জরুরি তা অনেকেই অনুভব করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সে বার্তা দিয়েছিলেন ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেই।
Powered by Froala Editor