মুসলমান কারিগরদের হাতেই ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হিন্দু দেবদেবীর; কলকাতায় সম্প্রীতির ঐতিহ্য এমনই

ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্লাস্টিকের ফ্রেম। একটা কাঠের পুরনো চৌকির উপরে বসে আছেন গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এমনকি মা দুর্গাও। ওই প্লাস্টিকের ফ্রেমের ভিতরেই বন্দি হবে দেবদেবীদের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তবে দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে আরেকটু ডানদিকে তাকালেই অবাক হতে হয়। সেই ঘরেই পাশাপাশি তিনটে পরিষ্কার গামছার উপর বসে নিঃশব্দে নামাজ পড়ে যাচ্ছেন তিনজন মানুষ। দুপুরের নামাজ। শেষ হলে উঠে এসে বসতে বসতে নাজমুল সাহেব বললেন, “আমাদের তো খিদেই ধর্ম। যে রোজগারের দিশা দেবে, সেই আমাদের ভগবান।”

সত্যিই চমক লাগে। যখন সারা দেশে ধর্মের নামে হিংসা ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই কলকাতা শহরের কেন্দ্রে একেবারে অন্ধকার একটি গলির মধ্যে এভাবেই মৈত্রীর বীজ বুনে চলেছেন কয়েকজন আপাত অশিক্ষিত মানুষ। মহম্মদ আলি পার্ক এবং প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির মাঝ দিয়ে যে রাস্তাটা কলুটোলা স্ট্রিট আর মহাত্মা গান্ধী রোডকে জুড়ে রেখেছে, তারই উপরে আছে কলকাতা পুলিশের মর্গ। মাঝেমাঝেই পথচলতি মানুষ সেখানে নাকে কাপড় চাপা দিতে বাধ্য হন। তবে এই রাস্তাটাকে তবু পরিষ্কারই বলা চলে। মর্গের গা দিয়ে যে গলিটা ঢুকে পড়েছে, তার উপর পা রাখলে মনে হয় যেন হঠাৎ করে কোনো অন্য জগতে এসে পড়েছি। রাস্তার ধারে ধারে নর্দমার জল উপচে পড়ছে। নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে রাস্তার ধারে ধারে পুরনো ইটের পাঁজরা বের করা একেকটা কামরা। কোনো কোনো কামরা দরজায় উদোম হয়ে বসে আছে সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু। এই গলির ভিতরেই নানাদিকে ঘুরে পৌঁছে গেলাম গৌরীভাইয়ের বাড়িতে।

গৌরীভাইয়ের বাড়িটা ওরই মধ্যে বেশ পরিষ্কার। খানিকটা বড়োও বটে। তাঁর ঠাকুরদা বিহার থেকে এসে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। আর এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত বিহার থেকে আসা মানুষদের জন্য সবসময় খোলা গৌরীভাইয়ের বাড়ি। তবে তাঁদের বেশিরভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এভাবেই এখানে আশ্রয় পেয়েছেন নাজমুল, ইয়াকুব, রাকিবরা। মুসলমান হয়ে হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি গড়ছেন তাঁরা। কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি এর জন্য? হাসতে হাসতে ইয়াকুব বলেন, “সবাই মূর্তিই কিনে নিয়ে যান। কে বানাচ্ছে, তার খোঁজই রাখেন না। এই আপনাদের লেখা পড়লে হয়তো অনেকেই আর কিনতে চাইবেন না।”

কীভাবে তৈরি হয় এইসব মূর্তি? সেসবও দেখালেন তাঁরা। প্রথমে নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয় পুরনো দিনের ছোটো ছোটো মূর্তি। তারপর সেই মূর্তি গায়ে ঢালাই করে ছাঁচ বানানো হয়। ছাঁচে প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে তৈরি হয় একেকটি প্লাস্টারকাস্টের মূর্তি। পরে রং করে প্লাস্টিকের খোলে বন্দি হয়ে পৌঁছে যায় বাজারে। প্রতিটা মূর্তির রং করতে হয় সূক্ষ্ম হাতে। কোথাও ভুল হয়ে গেলে আর মুছে ফেলার উপায় নেই। তবে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করে করে এখন আর ভুল সেরকম হয় না, বলছেন তিনজনেই।

এঁরা প্রত্যেকেই এসেছেন ৩০ বছর আগে। তার আগে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরাও ছিলেন বিহারের মুসলমান। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই এই কারখানা চলে আসছে, বলছিলেন কারখানার মালিক রামদাস। তিনি যদিও এখানে থাকেন না বেশিরভাগ সময়েই। মহারাষ্ট্রে তাঁর আরও নানা ব্যবসা আছে। “এখন আর এই প্লাস্টারকাস্টের ব্যবসায় লাভও তেমন হয় না। দেবদেবীর মূর্তি মানুষ কেনে কোথায়? যদিবা মেলায় বিক্রিবাটা হয়, মার্চ মাস থেকে তো সেসবও বন্ধ। বিক্রি নেই। তবু বলেছি, চালিয়ে যা ব্যাটা। কাজ করে যা। মূর্তি তো আর নষ্ট হবে না।” কিন্তু ব্যবসায় লাভ না হলে কর্মচারীদের মজুরিটা? “সেটা অন্য ব্যবসা থেকে দিতে হয়। এই সময় আমি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলে ওরাই বা যাবে কোথায়?”

বেরিয়ে আসতে আসতে দেখলাম বাড়ির বড় চাতালে শুরু হয়েছে রান্নার আয়োজন। গৌরীভাইয়ের বাড়িতে আরও নানা ধরনের কারখানা আছে। সেইসব কারখানার হিন্দু-মুসলমান কর্মচারীরা দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসবেন। মাছ ভাজা হচ্ছে। আর কী কী রান্না হবে? খোঁজ নেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, এই শহরের পরিচিত রাস্তার ঠিক কত কাছে পড়ে আছে গৌরীভাই, রামদাস, নাজমুল, ইয়াকুব রাকিবদের গল্প। সত্যিই রূপকথা নয়।

আরও পড়ুন
মূর্তিপূজা নয়, মহিষাসুরমর্দিনী পাঠেই শারদীয়া উদযাপন বেঙ্গালুরুর বাঙালিদের

Powered by Froala Editor

More From Author See More