স্ট্রিট মিউজিক বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, গোলপার্কে ‘মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ’ নিয়ে হাজির নীলাঞ্জন

গোলপার্ক থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের দিকের রাস্তা ধরে হাঁটার সময় অনেকেই হয়তো শুনেছেন গিটারের শব্দ। হয়তো চোখেও পড়েছে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সাইকেল আর তাতে টাঙানো সাইনবোর্ড ‘মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ’। স্ট্রিট ফুড আর স্ট্রিট মিউজিকের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। গত ৫ ডিসেম্বর দু’বছর পেরিয়ে গেল অভিনব এই উদ্যোগের। আর সেই উপলক্ষেই প্রধান উদ্যোক্তা নীলাঞ্জন সাহা জানালেন, মহামারীর আবহে দীর্ঘ দশ মাস বন্ধ থাকার পর এবার আবার খুলতে চলেছে মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ।

“এই ডিসেম্বর থেকেই আবার খোলার ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার জন্য খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া। আশা করি জানুয়ারির শুরু থেকেই আবার ফিরতে পারব আমরা”, বলছিলেন নীলাঞ্জন সাহা। 

তবে মাঝের এই সময়টায় মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ বন্ধ থাকলেও সম্পর্কে ফাঁক পড়েনি সঙ্গীতের সঙ্গে। বাড়িতে বসে নিজের মতো করেই সঙ্গীতচর্চা চালিয়ে গেছেন নীলাঞ্জন। গুছিয়ে নিয়েছেন নিজের বেশ কিছু ব্যক্তিগত প্রোজেক্টের কাজ। সেইসঙ্গে শেষ সেমিস্টারের পড়াশোনাও। তবুও স্ট্রিট মিউজিকের থেকে দূরত্ব, দৈনিক রুটিনে ছেদ— খানিকটা যে বিষণ্ণতা ঢেলে দেয়নি তেমনটা না।

বছর দুয়েক আগে এই স্ট্রিট মিউজিককে সঙ্গী করেই শুরু হয়েছিল পথ চলা। দু’চোখে স্বপ্ন ছিল কলকাতায় সুসংহতভাবেই গড়ে তোলা একটি স্ট্রিট মিউজিক হাব। তৈরি করা এমন একটা জায়গা, একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে যে কেউ এসে কণ্ঠ মেলাতে পারবে গানে, পছন্দের মানুষদের পেয়ে যাবে আড্ডার মেজাজে। “অনেক বার কিংবা রেস্তোরাঁয় এমন গান-বাজনা হয়। কিন্তু সেখানে ব্যাপারটা অনেক সফিস্টিকেটেড। কিন্তু যে কেউ তো গিয়ে গান করতে পারে না সেখানে। শুধুমাত্র প্রফেশনালরাই সুযোগ পান। আমি চেয়েছিলাম স্কুল-কলেজে যেমন বন্ধুরা আসর বসাই, আড্ডা মারি, তেমনই একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে”, কথায় কথায় শুরুর দিনগুলোর কথা তুলে আনছিলেন নীলাঞ্জন। 

পাশাপাশি বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে উপার্জনের একটা তাগিদও তাড়া করে বেড়াচ্ছিল পিছনে। সেখান থেকেই শুরু হয় মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ। গান-গিটার তো সঙ্গী ছিলই। বাড়তি বলতে শুধু যোগ হল স্যান্ডউইচ। তাও নিজের হাতেই বানানো। দাম মাত্র ১৬ টাকা। ২০১৮ সালের সেই ডিসেম্বর মাস থেকেই নীলাঞ্জনের ঠিকানা হল ভর সন্ধের গোলপার্ক। স্টল বলতে একটা সাইকেল মাত্র। মহীন থেকে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু, হেমন্ত-কিশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই-ই এসে জড়ো হতে লাগলেন গোলপার্কে। গানের মধ্যে দিয়ে। তবে লক্ষ্য ছিল সকলকেই অংশ করে নেওয়ার এই আড্ডার। হলও তেমনটাই। নীলাঞ্জনের পাশাপাশি অন্যরাও কণ্ঠ মেলালেন সুরে। কেউ ধরলেন গিটার। 

আরও পড়ুন
এখনও অনিশ্চিত কলকাতা বইমেলার ভবিষ্যৎ, কী ভাবছেন প্রকাশকরা?

তবে প্রতিকূলতা ছিলই। রয়েছে আজও। দিদি ইঞ্জিনিয়ার। তাই বাড়ি থেকে চাইত নীলাঞ্জনও যেন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েই পড়াশোনা করেন। তবে ভর্তি হয়েও প্রথম বর্ষের পরই সরে এসেছিলেন তিনি। বেছে নিয়েছিলেন গানকে। সেইসঙ্গে শুরু করেছিলেন ইংরাজিতে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা। “বাড়ি থেকে অনেকেই রাজি ছিল না যে আমি এই পথটা বেছে নিই। এখনও চায় না”, দীর্ঘশ্বাস মিশে যাচ্ছিল তাঁর কথায়।

এই উদ্যোগে প্রথম থেকেই সাড়া মিলেছিল বেশ ভালো। কিছু না হলেও দশ-বারো জন প্রতিদিনই হাজির হতেন মিউজিক্যাল এই ঠেকে। কিন্তু তারপরেও উপার্জনের পথ যে খুব কিছু প্রশস্ত ছিল, তেমনটা নয়। নীলাঞ্জন জানালেন, “ফেসবুক পেজের এত লাইক, শেয়ার দেখে অনেকে হয়তো ভাবেন বেশ লাভ করছি আমরা এই মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচ থেকে। কিন্তু তেমনটা একেবারেই না। যে টাকাটা আসে, তাতে একজনের সামান্য হাত খরচও চলে না।” জানা গেল মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচের সঙ্গে জড়িত আরও দুই উদ্যোক্তা অভিষেক দাস এবং রাজিত রায় বাধ্য হয়েছেন নতুন জীবিকার সন্ধান করতে। আত্মিক যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রয়েছে যদিও। নীলাঞ্জনবাবু জানান, “ওরা আমার পাশে না দাঁড়ালে এতটা পথ হেঁটে আসা সম্ভব হত না কোনোভাবেই। ওদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ আমি”। জানা গেল ব্যস্ততার মাঝে ফাঁক পেলেই মিউজিক্যাল স্যান্ডউইচের এই ‘স্টল’-এ হাজির হবেন তাঁরাও।

আরও পড়ুন
বিক্রি হয়ে গেল বব ডিলানের লেখা সমস্ত গানের স্বত্ব

অন্যদিকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের টিকিট কেটে, কিংবা নেহাতই টাকা দিয়ে গান শোনার অভ্যেসও। তবুও অসম এই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ প্রতিভা নীলাঞ্জন সাহা। “স্ট্রিট মিউজিকের ক্রাউড ফান্ডিং বা বাস্কিং একটা উপায়। কিন্তু তেমনটা একেবারেই আমার পরিকল্পনায় ছিল না কোনোদিনই। আমি মনে করি সেটার জন্য যে প্রফেশনাল গান-বাজনার দক্ষতা লাগে, সেই জায়গায় এখনও পর্যন্ত পৌঁছাইনি আমি। আমি মনে করি স্ট্রিট মিউজিক একটা প্ল্যাটফর্ম। সেই প্ল্যাটফর্মটায় যাতে আরও নতুনরা এগিয়ে আসে, সেটুকুই চেষ্টা।”

নিজের সেই স্বপ্ন সাফল্যের সঙ্গেই পূরণ করেছেন নীলাঞ্জন, তা বলেই বাহুল্য। তবে রাস্তার ধারে, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ক’জনই বা গান শোনেন? “আসলে একটা দোকান থাকলে অডিয়েন্স পাওয়া যায়। এইভাবে রাস্তার ধারে গান করলে অনেকেই দাঁড়ান না। ইচ্ছে আছে তেমনটা করার একদিন”, উঠে আসছিল শ্রোতাদের অভাবের কথা।

আরও পড়ুন
গান গেয়ে প্রথম উপার্জন ২৫ পয়সা, সব ছেড়ে চাষবাস করার কথাও ভেবেছেন উদিত নারায়ণ

তবে এতকিছুর পরেও হাল ছাড়তে নারাজ নীলাঞ্জন। আগামীদিনেও এই লড়াই চালিয়ে যেতে চান তিনি। এ বিষয়ে পুরোপুরিই বদ্ধপরিকর নীলাঞ্জনবাবু। স্বপ্ন বিপ্লব আনা বাংলার অলটারনেটিভ মিউজিকে, সেইসঙ্গে মাথার ওপর ছাদ তৈরি করে সঙ্গীতপ্রেমীদের একটা ঠিকানা তৈরি করারও উদ্দেশ্য অটুট রয়েছে মনে। আসলে তারুণ্যের কাছে হার মানে সবকিছুই। সমস্ত প্রতিকূলতাও যে শক্ত পদক্ষেপেই পেরিয়ে যাবেন নীলাঞ্জন, তাও নিশ্চিতই একপ্রকার। সেই লক্ষ্য নিয়ে জানুয়ারি কিংবা ডিসেম্বরের শেষ থেকেই নতুন করে পথ চলা শুরু হবে নীলাঞ্জনের। আবার নতুন করে ভাষা পাবে কলকাতার স্ট্রীট মিউজিক...

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More