ছোট থেকেই গান বাজনার প্রতি বড়ই টান ফিকু’র। অমৃতসরের নিজের গ্রামে ফকিরের গান শুনে একদিন বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, বাড়িতে কঠোর নিষেধ। গান গেয়ে জীবন চালানো? নৈব নৈব চ! দাদার প্রশ্রয়ে একটু একটু করে গান গাওয়া শুরু। তালিম নেওয়া তখন থেকেই। একদিন লাহোরে এলেন কে এস সায়গল। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হওয়ায় অনুষ্ঠান থমকে আছে। কিশোর ফিকু এই সুযোগে চলে গেলেন সায়গলের কাছে। গাইলেন কয়েকটি গান। মুগ্ধ হয়ে রইলেন কে এস সায়গল। জীবনের গল্পটা সেই মুহূর্তেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল ফিকু’র। বাকি গল্প ফিকু থেকে রফি সাহাব হয়ে ওঠার গল্প। ভারতীয় সিনেমার জগতে এক কিংবদন্তির গল্প। মহম্মদ রফি নামের এক মিথের গল্প।
মহম্মদ রফি কী, সেটা আজও কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না। প্রতিটা দিন কোথাও না কোথাও বেজে উঠছে ‘বাহারোঁ ফুল বরসাওঁ’, বা ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল’-এর মতো গানগুলি। এতগুলো প্রজন্মকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে যে মানুষটি, তাঁর চলার পথটি যে খুব মসৃণ ছিল তা নয়। বাড়ির পরিস্থিতি তো প্রথম থেকেই উল্টোদিকে ছিল। তা সত্ত্বেও তালিম নিয়েছেন উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খাঁ, পণ্ডিত জীবনলাল মাত্তু, বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের কাছ থেকে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দীক্ষিত ছিলেন রীতিমতো। তার মাঝপথেই সুযোগ চলে আসে। প্রথমে পাঞ্জাবের ছবিতে, তারপরেই ডাক দেয় মুম্বই। রফি থেকে রফি সাহাব হওয়ার ডাক।
সঙ্গীত জীবনে পেয়েছেন কিংবদন্তি সব সুরকারদের। আর প্রত্যেকেই রফি’র প্রতিভায়, গানে পাগল। সে শ্যাম সুন্দর হন, বা শচিন কর্তা, নৌসাদ, খৈয়াম—তালিকায় আছেন প্রায় প্রত্যেকেই। কিন্তু এতজনের এত পছন্দ কেন? সুরকার ঊষা খান্নাকে একবার এই প্রশ্ন করা হলে বলেছিলেন, “সেই সময়ের বলিউডে যারা ছিল, প্রত্যেকে গ্রেট সিঙ্গার। কিশোর, মুকেশ, মান্না দে… কিন্তু মহম্মদ রফি ইজ সামথিং স্পেশাল। আ জিনিয়াস। সেন্ট ফ্রম দ্য হেভেন বাই গড”।
সত্যিই তো! একই ভাবে এত রকমের গান নিজের জীবদ্দশায় গেয়েছেন রফি, ভাবলেও অবাক লাগে। বিরহের গান, প্রেমের গানের পাশাপাশি দেশাত্মবোধক, বিয়ের গান, কাওয়ালি, গজল, রাগাশ্রয়ী গান— সমস্ত কিছুই রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। আর এক্সপ্রেশন? নায়কের অভিব্যক্তি যেন অবলীলায় গলা দিয়ে বের করতেন তিনি। একটি সংবাদসংস্থা একবার একটি সমীক্ষা করেছিল। বিষয় ছিল মহম্মদ রফির গানে কত রকমের এক্সপ্রেশন আছে? ফলাফল দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! নিজের ২৬ হাজারের কাছাকাছি গানে প্রায় ৫১৭টা আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন বলিউডের ‘তানসেন’; স্রেফ গলা দিয়ে!
মহম্মদ রফিকে নিয়ে আলোচনায় কিশোর কুমার আসবেন না, তা কি হয়! কিশোর না রফি— ভারতের সর্বকালের সেরা বিতর্কগুলোর মধ্যে এটি অবশ্যই থাকবে। নিষ্পত্তি হয়নি এখনও, ভাগ্যিস হয়নি! একটা সময় এই দুজন রীতিমত সাম্রাজ্য চালিয়েছিলেন। আজও যারা একমেবাদ্বিতীয়ম, তাঁদের মধ্যে কি তুলনা চলে? বাঙালিরা বরাবরের কিশোর-প্রেমী; কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ফাঁক পেলেই রফির কাছে ছুটে যান না? বা রফি বলতে অজ্ঞান যারা, তাঁরা কি কিশোর কুমারের গানে ভাসেননি? মেসি-রোনাল্ডোর মতো থেকে গেছেন দুজনে। ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল দেখার মতো। ১৯৮০-এর ৩১ জুলাই, যেদিন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন রফি সাহাব, সেদিন তাঁর মৃতদেহের পাশে বসে অঝোরে কেঁদেছিলেন কিশোর কুমার।
মৃত্যুর প্রসঙ্গ এলেই, খানিক চুপ করে থাকা আমাদের নিয়ম। শেষদিনও গানের মধ্যেই ছিলেন তিনি— “শাম ফির কিঁউ উদাস হ্যায় দোস্ত/ তু কাহিঁ আস পাস হ্যায় দোস্ত”। বুঝতে পেরেছিলেন কি পরম বন্ধুর পদধ্বনি? কিছুক্ষণ পরেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, থেমে যায় বলিউডের স্বর। তানসেনের গলা থেমে যায় সেদিন। মৃত্যুতে প্রায় গোটা মুম্বাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছিল ভারত। সারাটা জীবন কোটি কোটি মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়েছিলেন তিনি। গান দিয়ে যে অন্ধ দর্শকটির দুনিয়া দর্শন করিয়েছিলেন, সেই গানের ভেতর দিয়েই যেন মৃত্যুকে পেলেন তিনি। পেলেন অমরত্ব। যাবতীয় তর্ক, অপমান, ঝগড়া সরিয়ে আজও তিনি আমাদের কাছের ‘রফি সাহাব’; অমৃতসরের সেই ছোট্ট ফিকু।
আরও পড়ুন
‘তোমার স্টাইলে গানটা রেকর্ড করলাম’ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে লিখে দিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
ঋণস্বীকার—
আনন্দবাজার পত্রিকা, স্মরণ ২০১৮, তানসেন
আর্টস বিডি নিউজ
Powered by Froala Editor