ভোরের আলো সবে ছুঁতে শুরু করেছে প্রকৃতিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে হলুদ আলো ক্রমশ গড়িয়ে পড়ছে সমতলে। তারই পাশে সভ্যতার বহমান ধারা হয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। কত উত্থান, কত পতন এর কোলে। কত দেহ মিলেমিশে এক হয়ে আছে এখানে। আর তারই পাশে বেড়ে উঠেছে এক প্রাচীন লোকগাথা— বেনারস। প্রতিটা সিঁড়ির ধাপ, ঘাট, শ্মশানে জ্বলতে থাকা ধিকিধিকি আগুন বেনারসের আত্মার সন্ধান দেয়। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসেন এক বৃদ্ধ। গঙ্গার জলে নিজেকে শুদ্ধ করে নিয়ে চলে যান মসজিদে। নিষ্ঠা ভরে নামাজ পাঠের পর শুরু হয় আরও এক মন্ত্র জপ। বৃদ্ধের শরীর বেয়ে চুইয়ে পড়ছে সঙ্গীতের রস। রাধাকৃষ্ণের প্রেমে বিভোর তিনি। একমনে মন্দির প্রাঙ্গণে বেজে চলেছে সানাই। স্বর্গের দেবতারাও বলে উঠছেন, ‘বিসমিল্লাহ!’
বিসমিল্লা খান আসলে কে? একজন কিংবদন্তি উস্তাদ? একজন সঙ্গীত নিবেদিত প্রাণ? একার হাতে সানাইকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মঞ্চে প্রতিষ্ঠা দিলেন যিনি? এসব তো তথ্যের কথা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহমান ধারা বিসমিল্লাকে অস্বীকার করতে পারবে না এটা ঠিকই। বিয়ের মণ্ডপ থেকে সানাইয়ের দেশ বিদেশের মঞ্চে উত্তরণ যার হাত ধরে, তিনি এর থেকেও বড়ো। কামিরুদ্দিন খাঁ থেকে বিসমিল্লা— এই যাত্রার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতের আসল মানচিত্রটি। পরিবারের সবাই সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা এবং পূর্বপুরুষেরা রাজ দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। কিন্তু বিসমিল্লাহ নিজের জায়গা খুঁজে পেতেন কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরেই। ধার্মিক শিয়া মুসলিম; অথচ প্রতিদিন দেবী সরস্বতীর পূজা অর্চনা করতেন। নিজেকে শুদ্ধ করে নিতেন এই করেই। তাঁর সানাই খুঁজে যেত ঈশ্বরকে; যে ঈশ্বর সমস্ত ধর্মের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
১৯৮৯ সালে পরিচালক গৌতম ঘোষ বিসমিল্লাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। ‘মিটিং আ মাইলস্টোন’। একদম শুরুর দৃশ্যটা মনে আছে? বেনারসের সনাতন ঘাট, নৌকা ভেসে আছে গঙ্গার বুকে। ধীরে ধীরে ভোরের প্রথম আলোর স্পর্শে জেগে উঠছে পাখিরা। নিস্তব্ধতা ভেদ করে বেজে উঠছেন বিসমিল্লাহ খান। তাঁকে বর্ণনা করতে এই দৃশ্যটির কথাই বারবার মনে আসে। সুমনের ভাষায়, ‘হাত পেতে চেটেপুটে খাই/বিসমিল্লার পাগলা সানাই’। যে পাগলা সানাইয়ের সুরে সবাই এক হয়ে গিয়েছিল ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারির দিনটিতে। মনে পড়ে দূরদর্শনের সেই সানাইয়ের আওয়াজ? যা দিয়ে একটা সময় শুরু হত ভারতের সকাল! ভারতের সর্বোচ্চ চারটে বেসামরিক সম্মানই (পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং ভারতরত্ন) অর্জন করেছেন। এ এক বিরল নজির। তা সত্তেও সাধারণ জীবনযাপনে বিশ্বাস করতেন। সেখানেই খুঁজে নিতেন নিজের সুর। এক হাতে মসজিদ, অন্য হাতে মন্দিরকে নিয়ে চলেছেন তিনি। আমেরিকার নাগরিকত্বের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ? বিশ্বনাথ শিবকে প্রতিদিন সঙ্গীত না শোনানো পর্যন্ত তো শান্তি পেতেন না তিনি…
বিসমিল্লার কথা বলতে গিয়ে গৌতম ঘোষ বারবার ফিরে গেছেন লালনের কাছে। সত্য— তাঁর সানাইয়ের সুরে, তাঁর জীবনের মূলে ভারতের সনাতন সত্য লুকিয়ে আছে। ভারতের আত্মাকে আরাধনা করতেন যিনি। আজকের ধর্মের বিবাদে ক্রমশ কলুষিত দেশের বাতাস। সেখানে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় অনেকের। খালি মনে হয়, বিসমিল্লা এখন থাকলে কী করতেন? হয়ত আবার সানাই নিয়ে বাজিয়ে নিতেন রাধাকৃষ্ণের লীলা। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরত জল। তাঁর মনে হত, যেন স্বয়ং বৃন্দাবন এসে হাজির হয়েছে তাঁর কাছে। ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা’… সেই রাধার মধ্যে দিয়েই নিজেকে জাগিয়ে তুলতেন বারবার। বিসমিল্লা নিজেই জলজ্যান্ত দর্শন। বেনারসের ছোটো গলির অতি সাধারণ ঘর, রিকশাই ছিল যার যাতায়াতের মাধ্যম— তিনি কি পারতেন না দূরে কোথাও গিয়ে থাকতে? ঈশ্বরকে ছেড়ে যাওয়া কি এতই সহজ!
বাংলার এক কবির কলমও সেই সত্যকে ধরে রেখেছে। কবি কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিসমিল্লার সাক্ষাৎ আলাপ ছিল কি? যেভাবে আবহমান কাল ধরে আমাদের মজ্জায় জড়িয়ে আছেন তিনি, সেভাবেই লিখেছিলেন এক চমৎকার কবিতা—
“বিয়েবাড়িতে একলা হওয়াই আমার স্বভাব, তবু
সব বাড়িতেই একটি দৃশ্যে থমকে যাচ্ছে প্রাণ
দেখেছি হিন্দু ললনাদের
প্রতিরাত্রে বিয়ে দিচ্ছেন বিসমিল্লা খান”
আরও পড়ুন
প্রয়াণ দিবসের ঠিক আগেই ধূলিস্যাৎ উস্তাদ বিসমিল্লা খানের বাড়ি, তৈরি হবে মাল্টিপ্লেক্স
তাঁর ঘরে আমাদের বাঁধা পড়তেই হবে একদিন না একদিন। হিন্দুও না, মুসলিমও না। প্রতিটা নামাজেও কি লুকিয়ে ছিলেন না কৃষ্ণ? বা কাশীর মন্দিরে এক কোণে বসে যখন দেবতাকে সঙ্গীত অর্পণ করছেন তিনি, তখনও কি ছিল না পয়গম্বর আল্লাহর স্পর্শ? আসলে সবই তো মিলেমিশে এক! যেখানে লালন আর বিসমিল্লা একই সুরে ভেসে ওঠেন। বেনারসের ভোরের মতো বেজে ওঠে তাঁর ভৈরবী সানাই। বিসমিল্লা আসলে চলে যাননি; ভারতের আত্মা যতদিন অটুট আছে, বিসমিল্লা ততদিন বেজে উঠবেন প্রতিটি আসরে। সমস্ত চিৎকার, দাঙ্গা, অন্যায়ের মাঝে শাশ্বত হয়ে বেজে উঠবেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে একদিন নগ্ন পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সক্রেটিস, সেভাবেই…
Powered by Froala Editor