“উনি বাংলার অন্যতম অভিনেতা, খুব ভালো পরিচালক, নাট্যকার, আবৃত্তিকার, কবি— ওঁর এতগুলো গুণের পাশাপাশি সঙ্গীতেও অগাধ পাণ্ডিত্য তা অনেকেই জানেন না। বিথোফেন, মোৎজার্ট কোন সালের; কোনটা রোম্যান্টিক পিরিয়ড, কোনটা ক্লাসিক্যাল পিরিয়ড; ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরানা— প্রতিটা বিষয়ই ছিল ওঁর নখদর্পনে…”
বলছিলেন ‘কলকাতা ইয়ুথ অনসেম্বল’ (Kolkata Youth Ensemble) অর্কেস্ট্রার ডিরেক্টর অমিতাভ ঘোষ। আর যাঁর সম্পর্কে এই কথোকথন, তিনি আর কেউ নন কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। হ্যাঁ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই (Soumitra Chattopadhyay) ছিলেন কলকাতার এই একমাত্র স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার পৃষ্ঠপোষক, মেন্টর। এবার তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রথমবার মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশ করতে চলেছেন তাঁরই স্নেহধন্য শিল্পীরা। আগামী ১৩ আগস্ট কলকাতার মধুসূদন মঞ্চ সাক্ষী হতে চলেছে এক অপার্থিব সুরসন্ধ্যার।
“যেহেতু আমি ফিল্মে কাজ করেছি, সেই সূত্রেই ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। যখন এই অর্কেস্ট্রা তৈরির কথা চিন্তাভাবনা করছি, তখন খুব ক্যাসুয়ালভাবেই ওঁকে জানিয়েছিলাম। সব শুনে উনি বলেছিলেন স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা করলে তো আমিই সাহায্য করতে পারি”, জানালেন ‘কলকাতা ইয়ুথ অনসেম্বল’-এর ডিরেক্টর তথা ভায়োলিন শিল্পী অমিতাভ ঘোষ। তবে তিনি নিজেও ভাবেননি কী বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য।
২০১৪ সাল সেটা। এই বাক্য বিনিময়ের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের বাড়িতে তলব করেন খোদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পাশ্চাত্য থেকে ভারতীয় সঙ্গীত— আলোচনার স্রোতে ভাসে সুরের প্রতিটি আঙ্গিকই। সেদিন শুধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডিত্যই অবাক করে দেয়নি অমিতাভবাবুকে, অবাক করেছিল সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগও। কোথায় রিহার্সাল হবে অর্কেস্ট্রার— সেটারও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ‘অপু’। তাছাড়া নিয়ম করেই প্রতিবছর হাজির হতেন তাঁর এই সাধের অর্কেস্ট্রার মঞ্চায়ন দেখতে। স্মৃতিচারণায় অমিতাভবাবু তুলে আনলেন সেইসব দিনের কথাই, “কখনও নিজের শ্যুটিং-এর শিডিউল পিছিয়ে, অন্যান্য কাজ বাতিল করেও আমাদের শো দেখতে হাজির হয়েছেন উনি।”
ভিএসটি অর্থাৎ ইলেকট্রনিক বা ভার্চুয়াল সাউন্ড ট্র্যাকের দৌলতে ক্রমশ মুছে যেতে বসেছে যন্ত্র সঙ্গীতের মাহাত্ম্য। কিন্তু সত্যিই কি বিসমিল্লার শানাই-এর স্বাদ আদৌ কি মেটাতে পারে ইলেকট্রনিক প্রতিস্থাপক? তবে আজকের সমাজের সঙ্গীতানুরাগ এগোচ্ছে সেদিকেই। ঠিক সেভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে অর্কেস্ট্রার দিন। বিশেষত, স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার মতো বিষয়, যেখানে শতাধিক সঙ্গীতশিল্পীদের যৌথ উপস্থাপনা সুরের ঝড় তোলে— সেটাই মুছে যাচ্ছে কলকাতা থেকে। অথচ, একটা সময় কলকাতাতেও ছিল তাবড় স্ট্রিং অর্কেস্ট্রা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা যেন সেই ইতিহাস সংরক্ষণের পক্ষেই ছিল আজীবন। বিপন্নতার কিনারে দাঁড়ানো সঙ্গীতের ধারাকে একটুকরো মুক্ত আকাশ খুঁজে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
আগামীকাল ‘কলকাতা ইয়ুথ অনসেম্বল’-এর হয়ে সঙ্গীত মঞ্চস্থ করবেন প্রায় ১২০ জন শিল্পী। তাঁদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক, কেউ পুলিশ আবার কেউ বিজ্ঞানের গবেষক। তাঁদের একত্রিত সুরের ঝংকারে কেঁপে উঠবে কলকাতা। তবে আগামীকালের অনুষ্ঠানটা একটু অন্যরকম হতে চলেছে অন্যবারের থেকে। প্রথমত, এবার অনুপস্থিত স্বয়ং মেন্টর সৌমিত্র। তাঁর জন্য বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন তো থাকছেই। তাছাড়াও, বিগত এক বছরে চলে গেছেন লতা মঙ্গেশকর, নির্মলা মিশ্র-সহ একাধিক খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী। তাঁদের বহু গানের উৎস খুঁজবেন কলকাতার একমাত্র স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা। হারমোনির মধ্য দিয়েই ফুটিয়ে তুলবেন সেই সোনালি দিনের ছবি…
Powered by Froala Editor