“নাদিম-শ্রাবণ জুটিকে রীতিমতো হিংসে হয় আমার।”
গত বছরের কথা। ‘টাইমস অফ মিউজিক’ শো-তে প্রকাশ্যে এমনটাই বলেছিলেন রাকেশ রোশন। ‘সাজান’ সিনেমার একটি বিখ্যাত গান ‘মেরে দিল ভি কিতনা পাগল হ্যায়’ প্রসঙ্গেই এমন মন্তব্য করেছিলেন তিনি। অকুণ্ঠভাবেই জানিয়েছিলেন, তৎকালীন সময়ে হিন্দি গানে ঢোলের এহেন ব্যবহার তিনি আর কোথাও দেখেননি। মন্ত্রমুগ্ধ রাকেশ রোশনের গলায় ঝরে পড়েছিল ভূয়সী প্রশংসা।
নব্বইয়ের দশকে যাঁদের বড়ো হয়ে ওঠা, তাঁদের কাছে ‘নাদিম-শ্রাবণ’ জুটি রূপকথার মতোই। বলতে গেলে এই জুটি ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলিউডের গানের ইতিহাস। চার দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর শেষ অবধি ছিন্ন হল সুতো। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত ভেঙে দিল ঐতিহাসিক সঙ্গীত-জুটিকে। কয়েকদিন আগেই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন নাদিম-শ্রাবণ জুটির শ্রাবণ রাঠোর। মাহিমের এসএল রাহিজা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রে সমস্যা ছিল আগে থেকেই। ফলে কোমর্বিডিটিই ঘাতক হয়ে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত। গতকাল রাতে হাসপাতালেই বিদায় জানালেন শ্রাবণ রাঠোর। বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
১৯৭৩ সাল। দৈববাণীই যেন মিলিয়ে দিয়েছিল দুই তারকাকে। দক্ষিণ ভারতে আয়োজিত একটি ফাংশানেই নাদিম আখতার সৈফির সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় শ্রাবণ রাঠোরের। সেই অনুষ্ঠানই যেন গড়ে দেয় রূপকথার যাত্রাপথ। শুরু হয় একসঙ্গে সঙ্গীতচর্চা, সুর তৈরির কাজ। বছর খানেকের মধ্যেই প্রথম সুযোগ আসে সিনেমার গান বানানোর। হিন্দি নয়, ‘দঙ্গল’ নামের একটি ভোজপুরি সিনেমা। ১৯৭৭ সালে সেই সিনেমা প্রকাশ্যে এল। নাদিম-শ্রাবণ রচয়িত সুরে কণ্ঠ মেলালেন মান্না দে। ‘কাশি হিলে, পাটনা হিলে’।
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কলকাতার সঙ্গীতশিল্পীরা, প্রকাশ পেল একের পর এক রেকর্ড
আঞ্চলিক জনপ্রিয়তা পেলেও, সারা ভারতে সেইভাবে তখনও জায়গা করে নিতে পারেননি নাদিম-শ্রাবণ। বছর চারেক বাদে এল প্রথম হিন্দি সিনেমার অ্যাসাইনমেন্ট। ‘ম্যায়নে জিনা শিখ লিয়া’। তারপর আনওয়ার সাগরের বাণিজ্যিক সঙ্গীত প্রোজেক্ট ‘স্টার টেন’। একটু একটু করে বলিউডের মধ্যে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন নাদিম-শ্রাবণ জুটি। ১৯৯০-এ এল বড়ো সাফল্য। ‘আশিকি’ সিনেমার সঙ্গীতেই জ্যাকপট হাতালেন দুই তারকা। এক কথায় যাকে বলে সুপারহিট।
আরও পড়ুন
ভ্রাম্যমাণ ট্রাকেই সঙ্গীত পরিবেশন ভেনেজুয়েলার শিল্পীর
শুধু নাদিম-শ্রাবণের সাফল্যই নয়, বলিউড সঙ্গীতে ‘আশিকি’ সিনেমাটির রয়েছে আরও একটি বিশেষ গুরুত্ব। হ্যাঁ, এই সিনেমাতেই অভিষেক হয়েছিল কুমার শানুর। আর তার নেপথ্যে ছিলেন নাদিম-শ্রাবণই। তরুণ কণ্ঠশিল্পী কুমার শানুকে শুধু সুযোগ করে দেওয়াই নয়, পর পর সব কটি গানই তাঁকে গিয়ে গাইয়েছিলেন কিংবদন্তি সুরকার জুটি। ‘আশিকি’-র জনপ্রিয়তা না থাকলে হয়তো বলিউডের মূলমঞ্চে জায়গা পাকা করে নিতে আরও বেশ খানিকটা দেরিই হতো কুমার শানুর।
আরও পড়ুন
অবসাদ কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে সঙ্গীতশিল্পী জেমস আর্থার, জানালেন অভিজ্ঞতা
নব্বইয়ের দশক ছিল নাদিম-শ্রাবণ জুটির কাছে স্বর্ণযুগ। বলিউডের কাছেও। আশিকির পর ‘সাজন’ (১৯৯১), দিল হ্যায় কি মানতা নাহিন (১৯৯১), সাথী (১৯৯১), সাদাক (১৯৯১), দিওয়ানা (১৯৯২), দিলওয়ালে (১৯৯৪) এবং রাজা হিন্দুস্তানি-সহ (১৯৯৬) জনপ্রিয় একাধিক ছবিতে সুর দিয়েছেন তাঁরা। ২০০৫ সালে ‘দোস্তি’ সিনেমাতে শেষ একসঙ্গে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল নাদিম-শ্রাবণকে। বলিউড থেকে এই জুটি বিদায় নিলেও অবশ্য অটুট ছিল দুই তারকার বন্ধন।
নাদিম-শ্রাবণ জুটির ‘রাজত্বে’ এক নতুন মোড় নিয়েছিল হিন্দি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, আশির শেষের দিকে বা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তখন হিন্দি ছবির গান বিশেষ করে জোর দিচ্ছে মিউজিকের ওপরে। সেখানে লিরিকের দাপট সেখানে খানিকটা কম ছিল বললেই চলে। পাশাপাশি ততটাও কি গুরুত্ব পেতেন গীতিকাররা? সেই গতি-প্রকৃতিকেই পুরো উল্টে দিয়েছিলেন নাদিম-শ্রাবণ। স্বতন্ত্র মিউজিকের সঙ্গে মনকাড়া কথার মিশেলেই জাদু ছড়িয়েছিলেন সঙ্গীত জগতে।
প্রত্যেক সঙ্গীত রচয়িতার সঙ্গেই জুড়ে থাকে একটি বিশেষ ধারা বা ঘরানা। যেমন লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলালের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ম্যানডোলিন এবং ঢোলকের ব্যবহার, বাপ্পি লাহিড়্র সঙ্গে জুড়ে আছে ডিস্ক বিট— তেমনই বোম্বের ঢোলের ব্যবহারকে নিজেদের সিগনেচার স্টাইল করে তুলেছিলেন নাদিম-শ্রাবণ। তৈরি করে দিয়েছিলেন হিন্দি চলচ্চিত্র সঙ্গীতের এক অন্য আবহ। নাদিম-শ্রাবণ জুটির পরে এই যন্ত্রের ব্যবহার ততটাও কি সফলভাবে করতে পেরেছিলেন কেউ? এই প্রশ্নের উত্তর বছর খানেক আগেই পাওয়া গেছিল রাকেশ রোশনের থেকে।
তবে প্রায় দেড় দশক আগে বলিউড থেকে বিদায় নিলেও, আজও সমান-ভাবেই প্রাসঙ্গিক এই দুই তারকা। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎসবের সময় ঘনালেই আজও নিয়ম করে বেজে ওঠে নাদিম-শ্রাবণ জুটির সঙ্গীত। তাদের কালজয়ী না বলে উপায় কী? শ্রাবণের মৃত্যুতে সেই ইতি পড়ল সেই দীর্ঘ অধ্যায়টায়…
Powered by Froala Editor