মেট্রো-টানেল তৈরির সময় উদ্ধার প্রত্নসামগ্রী, ঠাঁই পেল স্টেশনেই

কয়েক দশক আগের কথা। আমস্টেল নদীতে (Amstel River) ফেরির সংখ্যা কমাতে বিশেষ মেট্রোলাইন তৈরির পরিকল্পনা করে আমস্টারডাম (Amsterdam) প্রশাসন। যা সংযুক্ত করবে নদীর দুই প্রান্তকে। দীর্ঘ বিতর্কের পর অবশেষে ২০০৩ সালে শুরু হয় এই প্রকল্প। আর এই কাজ শুরু হতেই খুলতে শুরু করে ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য প্রত্নসামগ্রী। 

হ্যাঁ, এ যেন অনেকটা গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার মতোই। প্রাথমিকভাবে এই টানেলের খননকার্যের সময় বেশ কিছু প্রাচীন মুদ্রা এবং পাথরের হাতিয়ার খুঁজে পেয়েছিলেন কর্মীরা। তারপরই টনক নড়ে প্রশাসনের। দেরি না করে, প্রযুক্তিবিদদের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি বিশেষ দল নিয়োগ করে আমস্টারডাম সরকার। 

অবশ্য এই কাজ সহজ ছিল না মোটেই। একদিকে ভারী মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে তৈরি হচ্ছে টানেল। অন্যদিকে নবনির্মিত টানেলের মধ্যে উত্তোলিত মাটিকে পরিস্রুত করে প্রত্নসামগ্রী নিষ্কাশনের কাজ শুরু করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। বসানো হয় বিশেষ যন্ত্র এবং হাই-প্রেসার ওয়াটার রিজার্ভার। অনেকটা ডুবুরির মতোই এই রিজার্ভারে নেমে কাজ করতে হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের। তবে কথায় আছে, ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’। এক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনটাই। বৃথা যায়নি পরিশ্রম। শুধু আমস্টেল নদীর উত্তরপ্রান্ত থেকে রোকিন স্টেশনের মধ্যবর্তী অঞ্চলেই সবমিলিয়ে প্রায় ৭ লক্ষ প্রত্নসামগ্রীর হদিশ পেয়েছিলেন গবেষকরা। 

মজার বিষয় হল, এর মধ্যে কিছু সামগ্রীর বয়স দেড় লক্ষাধিক বছর, আবার কোনো কোনো সামগ্রীর বয়স মাত্র কয়েক দশক। এই তালিকায় রয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার বছর পুরনো শামুকের জীবাশ্ম, প্রাগৈতিহাসিক বন্যপ্রাণীর হাড়, ২০ হাজার বছর বয়সি মানুষের তৈরি পাথরের বিভিন্ন হাতিয়ার এবং সামগ্রী, মধ্যযুগীয় ধাতব বর্ম, তলোয়ার, মাটির পাত্র, রৌপ্য এবং স্বর্ণমুদ্রা, এমনকি মোবাইল, ক্যালকুলেটারের মতো ইলেকট্রনিক সামগ্রী। 

প্রশ্ন থেকে যায়, এমন বিচিত্র প্রত্নসামগ্রীর সহাবস্থানের কারণ কী? আসলে আমস্টেল নদী গতিপথ পরিবর্তন করেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আজ যেখান দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এই নদী, সেখানে একসময় ছিল ঘন অরণ্য। প্রাচীন মানুষের বাসস্থান, হাতিয়ার এবং বন্যপ্রাণীর দেহাংশ উদ্ধার প্রমাণ দেয় সেটারই। তবে সাম্প্রতিক প্রত্নসামগ্রীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকে আমস্টেল নদীতে বর্জ্য ফেলার চল বাড়ে। যা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রিত হলেও, বন্ধ হয় সম্পূর্ণভাবে। আর সেই কারণেই মোবাইল কিংবা ক্যালকুলেটারের মতো বৈদ্যুতিন যন্ত্রেরও সন্ধান পাওয়া গেছে এই অঞ্চলে। 

উল্লেখ্য, এই প্রত্ন-উদ্ধারের কার্যকলাপের জন্য মাত্র সাড়ে ৪ কিলোমিটার পথ তৈরিতেই লেগে যায় ১৫ বছর। ২০১৮ সালে চালু হয় আমস্টারডাম মেট্রোর উত্তর-দক্ষিণ করিডোর। আর তারপরই বিশেষভাবে সাজিয়ে তোলা হয় রোকিন রেলস্টেশনটিকে। ইতিহাসকে স্মরণে রেখেই বিশেষ রূপ দেওয়া হয়েছিল এই স্টেশনকে। এবার সেখানেই খুলে গেল আস্ত এক মিউজিয়াম। রয়েছে ১০ হাজার প্রত্নসামগ্রী। যাত্রীরা অনায়াসেই ঘুরে দেখতে পারেন সেসব। আমস্টারডাম মেট্রোর ইতিহাস সংরক্ষণের এই বিশেষ উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়েছেন ইতিহাসপ্রেমীরা। এমনকি এই ভূগর্ভস্থ জাদুঘরের সৌজন্যে ইতিমধ্যেই নতুন টুরিস্ট-হটস্পট হয়ে উঠেছে রোকিন মেট্রো স্টেশন… 

Powered by Froala Editor