পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশন থেকে নেমেই রাস্তার মুখে আপনার জন্য অপেক্ষা করবে এশিয়াটিক সোসাইটির ঐতিহাসিক ভবনটি। আশেপাশে অত্যাধুনিক রূপ নিয়ে হাজির শহরের প্রাক্তন সাহেব পাড়া। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে ‘প্রাক্তন’ শব্দটি ব্যবহার করাই যায়। কারণ এই মুহূর্তে যে রাস্তায় নেমে পড়া, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশরা। আধুনিক কলকাতা, আধুনিক আদবকায়দার সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাস। মিশে আছে না-বলা শহরটার একটা রূপ।
রাস্তা ধরে এগোতে লাগল সময়ের গাড়ি। গন্তব্য ৮৫, পার্ক স্ট্রিট। কী আছে এই ঠিকানায়? কোনো নতুন গুপ্তধন? সেসব অবশ্য জানা নেই। তবে প্রাথমিকভাবে এই ঠিকানায় পৌঁছলে একটু হতাশ হতে হবে। সামনে বিশাল বড়ো মাঠ, ভেতরে ইতিউতি হয়ত দেখতে পাবেন পার্কিংরত গাড়ি। ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে একটি বাড়ি। বেশ বড়ো, দেখেই মনে হয় পুরনো কলকাতার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে; কিন্তু অবস্থা শোচনীয়। কোথাও ভেঙে পড়েছে বাড়ির অংশ, কোথাও আবার সিমেন্ট আর ইট ভেঙে পড়ে বেরিয়ে এসেছে লোহার হাড়গোড়। ভেতরে কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে ঘুসঘুসে কাশির আওয়াজ। শহর কলকাতা ও বাংলার ইতিহাসের এক হারিয়ে যাওয়া অংশ হয়ে এভাবেই টিকে আছে পার্ক স্ট্রিটের মুর্শিদাবাদ হাউজ।
বহু ইতিহাস, বহু উত্থান পতনের সাক্ষী এই বাড়ি। আর হবে নাই বা কেন? বাড়িটি যে স্বয়ং মুর্শিদাবাদের নবাবদের! একটু পাদপূরণ করা যাক। ১৭৫৭ সাল। পলাশির মাঠে ইংরেজ বাহিনির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন মুর্শিদাবাদ ও বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। যুদ্ধ ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল; হঠাৎই ভোল বদল করেন নবাবের সেনাধ্যক্ষ মীর জাফর। সেই সময়ের ঐতিহাসিকরা অবশ্য বলেন, 'অত্যাচারী' সিরাজের থেকে নিষ্কৃতি পেতেই মীর জাফরের এমন 'বিশ্বাসঘাতকতা'। যাই হোক, এর ফল হল, সিরাজের পতন এবং হত্যা; ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসা বাংলা ও ভারত এবং প্রায় সাহেবদের হাতের পুতুল হয়ে নবাব হয়ে মীর জাফরের মসনদে বসা। এর পরের ইতিহাস অবশ্য ক্রমশ ধ্বংসের। একটা সময় মুর্শিদাবাদের নবাব যে ক্ষমতা আর ধনদৌলত ভোগ করতেন, সেসব একটু একটু করে চলে যেতে থাকে। মীর জাফরেরও তখন শেষ অবস্থা। সাধের সাম্রাজ্য যে অস্তমিত, সেটা কি বুঝেছিলেন তিনি?
এই পতনের ইতিহাসেরই এক নিদর্শন হল মুর্শিদাবাদ হাউজ। ঠিক কবে এই বাড়িটি তৈরি হয়েছিল, তা সঠিক করে বলতে পারেন না কেউ। তবে সিরাজ-উদ-দৌলার পরেই এর পত্তন, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। কলকাতা আক্রমণকালে সিরাজ খুব বেশিদিন এই শহরে থাকেননি। কাজেই রাতারাতি একটা আস্ত মহল বানিয়ে কয়েকদিনের জন্য থাকা, সেটা খুব একটা বাস্তবসম্মত বুদ্ধি নয়। যাই হোক, মনে করা হয় উনবিংশ শতকের আশেপাশে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে মীর জাফরের বংশধররা এখানে থেকেছেন। পুরনো দিনের ছবি দেখলে ঝাঁ-চকচকে রূপটা কিছুটা কল্পনা করা যায়। পাঁচিল পেরোলে বিশাল দোতলা বাড়ি; সামনের অর্ধচন্দ্রাকৃতি প্রবেশপথটি নিশ্চয়ই চোখ টানবে। এছাড়া বনেদি কলকাতার বাড়িগুলোর মতোই এর বৈশিষ্ট্য।
আজ সেই রূপের সেরকম কিছুই অবশিষ্ট নেই। বাড়িটাই কোনমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার গা বেয়ে উঠেছে মোটা মোটা শিকড়। এখানে ওখানে ঝোপঝাড়, কোথাও বাড়ির ভেঙে পড়া অংশের চিহ্ন। অথচ এই সেদিনও বাড়িতে আসর বসত নাচের। মাথায় উড়ত নবাব বংশের পতাকা, আর ভেতরে অধিষ্ঠান স্বয়ং নবাবের। ১৮৮০ সালে ‘বাংলার নবাব’ উপাধিটা চিরকালের মতো কেড়ে নেয় ব্রিটিশরা। তখন থেকে স্রেফ মুর্শিদাবাদের নবাব। আজও নবাবের খাস ভৃত্যদের কয়েকজনের পরিবার বংশপরম্পরায় বাস করেন এখানে। ভেতরের বিরাট হলঘর, মার্বেল বাঁধাই মেঝে— সব নির্বাক! আসবাবপত্র কবে ‘লোপাট’ হয়ে গেছে! নবাবি বংশটাও তো আর…
১৯০৬ সালে মুর্শিদাবাদের নবাবের সিংহাসনে বসার পর সৈয়দ ওয়াসিফ আলি মির্জা খান বাহাদুর এখানেই থাকতে শুরু করেন। তাঁর চোখের সামনেই এল স্বাধীনতা। কিন্তু কেউ কি মনে রাখল মীর জাফরের এই বংশধরদের? পার্ক স্ট্রিটের মুর্শিদাবাদ হাউজেই ১৯৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর মারা যান ওয়াসিফ আলি মির্জা খান। তারপর তাঁর ছেলে ওয়ারিস আলি মির্জা ছিলেন মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব। ১৯৬৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেমে যায় ইতিহাসের এক ধারা। থেমে যায় মুর্শিদাবাদ হাউজের পথ চলাও। সেই তখন থেকে একটু একটু করে ধুলো হয়ে যাচ্ছে বাড়িটি। ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে হয়; অথচ এই বাড়িটি একপ্রকার আড়ালেই থেকে গেল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্রাস্টের হাতে থাকলেও সংরক্ষণের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সেই সবের বাইরে, পার্ক স্ট্রিটের হাইরাইজের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নপ্রায় মুর্শিদাবাদ হাউজ।
আরও পড়ুন
বাঁকুড়ায় গুলিবিদ্ধ প্রাচীন মল্লবংশের বর্তমান রাজা; আত্মহত্যা না খুন? ধন্দে পুলিশও
Powered by Froala Editor