ডিউয়েন বোগলের বয়স ১৮ বছর। আর তাঁর প্রেমিকা প্যাট্রিসিয়া কালিৎস্কে ষোড়শী। পড়ে দু’ ক্লাস নিচুতে। দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা প্রদেশের গ্রেট ফল হাই স্কুলের শিক্ষার্থী। বাড়িতে জানিয়েই এক সন্ধেবেলা দু’জন গিয়েছিলেন রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে। সন্ধে কেটে রাত নামল শহরে। কিন্তু ফেরার নাম নেই। খোঁজ নিতে রেস্তোরাঁতে পৌঁছালেন বাড়ির লোকেরা। রেস্তোরাঁর কর্মীরা জানালেন, তাঁরা এসেছিলেন ঠিকই; তবে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছেন সেখান থেকে। তবে কি পালিয়ে গেল কিশোরযুগল? বাধ্য হয়েই পুলিশের খাতায় মিসিং ডায়েরি লেখালেন বাড়ির লোকেরা।
পরদিন সকালে, স্থানীয় কয়েকজন যুবকের চোখে পড়ল গ্রেট ফলসের খরস্রোতা নদীর জলে ভাসছে এক মৃতদেহ। কোমরের বেল্ট দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা দু’হাত। গুলিতে থেঁতলে গেছে মাথার পিছনের দিক। দেহটি উদ্ধার করতে এসেই চমকে উঠলেন পুলিশ আধিকারিকরা। মৃতদেহটি বোগলের! ঠিক তার আগের রাতেই মিসিং ডায়েরি জমা পড়েছিল তাঁর নামে। আর তাঁর প্রেমিকা? প্রাথমিকভাবে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে বলেই ধরে নেয় পুলিশ। কিন্তু ভুল ভাঙে পরেরদিন। আরও মাইল পাঁচেক দূরে, একটি নির্জন স্থানে খুঁজে পাওয়া যায় প্যাট্রিসিয়ার মৃতদেহ। খুন করা হয়েছে একইভাবে। সেইসঙ্গে ধর্ষণও।
এই ঘটনা আজকের নয়। ১৯৫৬ সালের। তবে বহু তদন্তের পরও এতদিন ধরে অমীমাংসিত ছিল এই জোড়াখুনের মামলা। প্রায় ছ’দশক পর এবার সমাধান মিলল তার। জেনেটিক জিনিয়ালজির মাধ্যমে মন্টানার পুলিশ সেরিফ জন ক্যাডনার রহস্যোন্মোচন করলেন ঘটনাটির। আর খুনি? তাঁর পরিচয় পাওয়া গেলেও, শাস্তি দেওয়া সম্ভব হল না তাঁকে। কারণ, ২০০৭ সালেই প্রয়াত হয়েছেন তিনি। কিন্তু খুনিই যদি মৃত হয়, তবে এই ঘটনার রহস্যভেদ হল কীভাবে?
মন্টানার এই জোড়াখুনের মামলার তদন্ত শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৬ সালেই। সেসময়ে পুলিশ আধিকারিকরা প্রস্তুত করেছিলেন ৩৫ জন সন্দেহজনক অপরাধীর একটি তালিকা। সেই তালিকার ওপরে মূলত তদন্ত চলে আসছিল এতদিন ধরে। প্রত্যেকের ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকলেও, এই খুনের সঙ্গে তাঁদের কোনোরকম সম্পর্ক খুঁজে বার করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।
আরও পড়ুন
প্রকাশ্য সভায় মনোবিদকে খুন, সমকামী সিলভারস্টাইনের ‘প্রতিবাদে’ হতবাক শ্রোতারা
বছর তিনেক আগে নতুন করে এই মামলার খাতা খোলা হলে, তদন্তের দায়িত্ব পান গোয়েন্দা সার্জেন্ট জন ক্যাডনার। মন্টানার তৎকালীন বিভিন্ন নথি ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনিই প্রথম লক্ষ করেন, খুনের ঠিক পর পরই মন্টানা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান গ্রেট ফলসের এক বাসিন্দা কেনেথ গোল্ড। যিনি ছিলেন একজন ঘোড়সওয়ার। প্যাট্রিসিয়ার বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরেই ছিল তাঁর বাড়ি। না, কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ডই মেলেনি তাঁর নামে। কিন্তু তাঁর রহস্যজনক প্রস্থানই ভাবিয়ে তুলেছিল ক্যাডনারকে।
আরও পড়ুন
খুনের অভিযোগ, ছদ্মবেশে পলায়ন ও গ্রেপ্তার; সুশীল কুমারের ঘটনা যেন বলিউডি চিত্রনাট্য
প্যাট্রিসিয়ার উত্তরসূরিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি তেমন। আদৌ কেনেথ প্যাট্রিসিয়ার পরিচিত ছিলেন কিনা— সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন ক্যাডনার। শেষে বিকল্প হিসাবে তিনি বেছে নেন জিন প্রযুক্তিকেই। প্যাট্রিসিয়ার মৃতদেহ থেকে ১৯৫৬ সালে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্ষকের কিছু শুক্রাণু। সেই নমুনা বিগত ছ’দশক ধরেই সংরক্ষিত হয়েছিল পুলিশের ভল্টে। তদন্তের খাতিরে আবার বার করা হয় সেই নমুনা। পাঠানো হয় ভার্জিনিয়ার সংস্থা বোদে টেকনোলজিতে। বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় ডিএনএ সিকোয়েন্স। কিন্তু শুধু তথ্য পেলেই তো হবে না, তার সঙ্গে সন্দেহজনক অপরাধির ডিএনএ-র সাদৃশ্য খুঁজে বার করতে হবে যে। এদিকে কেনেথ গোল্ড যে প্রয়াত হয়েছে বহু বছর আগেই।
আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?
শেষ অবধি তাঁর তিন সন্তানের ডিএনএ সংগ্রহ করে একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেন ক্যাডনার। তৈরি করা হয় গোল্ডের সম্ভাব্য ডিএনএ সিকোয়েন্স। আর তার সঙ্গেই হুবহু মিলে যায় ১৯৫৬ সালে সংগৃহীত সেই নমুনার নথি। তবে অপরাধীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও, যোগ্য বিচার পেলেন না গ্রেট ফলসের কিশোরযুগল!
তবে মন্টানার এই জোড়াখুনের মামলার নিষ্পত্তি তৈরি করল এক নতুন ইতিহাস। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে রহস্যোন্মোচনে গোয়েন্দাদের কাছে ডিএনএ টেকনোলজি নিঃসন্দেহে একটি বড়ো হাতিয়ার। এর আগে ৫০ বছর পুরনো একটি মামলার নিষ্পত্তি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল এই প্রযুক্তি। এবার ভেঙে গেল সেই রেকর্ডও। যা এক কথায় নজিরবিহীনই বটে…
Powered by Froala Editor