সাতশো রকমের ফুল, ঢেউ-ঢেউ চা-বাগান, গজরাজ আর তিন নদীর দেশের গল্প

বনমোরগ আর সাতশো রকম ফুলেরা ঘর করে সেখানে। সঙ্গে লাল-বেগুনি-সবুজ গাছেদের বাসা। পর্যটকদের ঢল নামলেও যার মায়া আজও ফুরোয়নি। আজ সেই পাহাড়ি টাউনের গল্প মুন্নার।

উত্তরে আনামুদি পর্বতশৃঙ্গ আর খানিক দক্ষিণে দারুচিনি পাহাড়ের সুবাসে ঘেরা মুন্নার। কেরালার পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার কোলে বেড়ে উঠেছে এই পাহাড়-কন্যে। তিনটি নদী মুধিরাপুয়া, নাল্লাথানি ও কুন্দালী এঁকেবেঁকে একত্রে বয়ে চলেছে মুন্নারের বুক চিরে। মুন্নার শব্দটির মানেও তাই হয়তো তিন নদী।

একটা বাচ্চাকে পাহাড় আঁকতে বললে পদার্থবিদ্যার সমস্ত নিয়ম অস্বীকার করে সে যেমন খুশি রাস্তা, পাহাড়, নদী, উঁচু উঁচু গাছের মেলা এঁকে ফেলে কাগজ জুড়ে, ঠিক তেমনই দেখতে এই খাড়াই উৎরাই ডাঙাখানা। দূর থেকে দেখলে সবুজ পাহাড়ি শরীর, কাছে গেলেই ভ্রমরের মতো উঁকি দেয় সাতরঙা ফুলের ফাঁকি। বিস্তৃর্ণ এলাকার পাহাড়ি গা জুড়ে চায়ের সুবাস লেগে থাকে শেষ রাত অবধি।পাহাড়ের সর্পিল রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে দূরে এদিকওদিক ভিড় করা কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়গুলো দেখে মনে হয়, যেন ট্রেসিং পেপারে হালকা থেকে গাঢ় করে তোলা ছাপ।

কাছেই ইকো ভ্যালি। ওখানে গিয়ে পা রাখা মাত্রই তারস্বরে ডাক পাড়ুন কারও উদ্দেশ্যে। সে শুনতে পাক না পাক, ওপারের বন আর গোড়ালি দূরত্বের জলে সে ডাক বারবার ধাক্কা খেয়ে গাছেদের ঘুম ভাঙাবেই! হাঁক পাড়তে পাড়তে অলক্ষ্যে একবার যদি নদীর জলের দিকে চোখ পড়ে তো দেখবেন ইকো ভ্যালির জলের উপর যা কিছু আছে, সবটাই প্রতিবিম্বিত হয় জলের গায়ে, এমনকি ভেসে থাকা আধখানা সাদা পাথরও পূর্ণতার চুক্কি দেবে।

ইকো ভ্যালির কাছাকাছিই টাটার আয়ত্বে থাকা চা বিক্রয় কেন্দ্র। হাজারে হাজারে চা শ্রমিক রোজ মেহনত করে হরিৎ চায়ের পাতা তুলে প্যাকেটে করে সাজিয়ে রাখে কাঁচের ঘরে। চা কিনে ফিরতি পথে এক দু’খান ড্যাম দেখা দেয় চওড়া ব্রিজের দিকে আড়চোখে চেয়ে। সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে কান পাতলে ড্যামের কারিগরদের হাতে উপড়ে নেওয়া, সংলগ্ন হাটবাজারের সব্জির দরদাম শুনতে পাবেন আজও। ট্যুরিজমের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল এই আস্ত পাহাড়টির মানুষজন।

লাল মাটির গায়ে বেয়ে ওঠা জংলা ফুলগুলোর নিচে ঝাঁ-চকচকে পিচের রাস্তা। তবুও চোখের অলক্ষেই গাছেরা রবি ঠাকুরের দাঁড়ির মতো বড় বড় ঝুরি আর পাতার সাজি দিয়ে ঢেকে দেয় হোর্ডিং আর পিচের রাস্তাগুলোকে। হঠাৎ হঠাৎ চলে আসা পাতায় ঢাকা সিঁড়িগুলো কোথায় নিয়ে যাবে আরোহীকে, কেউ জানে না। পথ ভুলে কোনো এক জলপ্রপাতের সামনে এসে পড়তে ভিজতেই হবে, নিস্তার নেই! মেঘেরাও ডানার মতো পিঠে এসে বসে না এখানে, ছাতার মতোন বেশিরভাগ সময় ওড়ে, আর কখনো কখনো রোদের মধ্যেও ছাতা ঝারা দিলে যেমন ভিজে যায় রাস্তা, তেমন ভিজিয়ে দিয়ে বুক হিম করে চলে যায়। রাস্তায় কখনও চকিতে দেখা দিয়ে যেতেই পারেন গজরাজ। তারও মেঘের মতোই দেহভার…

অবশেষে সন্ধে যখন নাবু নাবু আর হেলান দেওয়া একতলা বাড়িগুলোতে দোর দিয়েছে কেউ কেউ, ব্যস্ত গ্রাম ঝাঁপ নামায় তখন। আর দু’এক জন কাস্টার্ডের বাতাসি ঢেউ নাকে বয়ে নেমে আসে কৌতূহলে, বুকে ঘুম আর মাথায় আবেগ নিয়ে…

মুন্নারকে এ’কারণেই মাঝেমাঝে মেঘপিয়ন বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়।

More From Author See More