পিরামিডের ভিতরে নির্দিষ্ট কক্ষে কয়েক হাজার বছর ধরে সুরক্ষিত রয়েছে অসংখ্য মমি। কিন্তু তাদেরই একবার বাইরে বের করে আনলে রক্ষা করা বেশ কঠিন। কারণটাও খুব সাধারণ। বাইরের পৃথিবীতে এত দূষণ এবং জীবাণুর মধ্যে মমি সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয়। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে ইজিপ্ট সরকারের পক্ষ থেকে তাই আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ সংস্থা গেটি কনজার্ভেশন ইনস্টিটিউটের কাছে মমি রাখার জন্য ২৭টি শোকেসের (Mummy Case) আবেদন জানিয়েছিল। না, এতে চমকে ওঠার তেমন কিছু নেই। কিন্তু সেই বছর গেটি-র কাছে আরও একটি দেশ মমি রাখার শোকেসের আবেদন জানিয়েছিল। আর সেই দেশটি হল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারত।
ভাবছেন ভারত মমি রাখার বাক্স নিয়ে কী করবে? মমি নয়, আসলে দেশের সংবিধান (Indian Constitution) সযত্নে রেখে দিতেই মমির বাক্সের আবেদন জানিয়েছিল সরকার। না, সরকার বললে একটু ভুল হবে। স্বাধীন ভারত সরকার তখনও তৈরি হয়নি। দেশের সংবিধান সংসদ থেকেই আবেদন করা হয়েছিল দুটি মমি রাখার বাক্সের। আজও ভারতীয় সংসদের সংগ্রহশালায় সেই বাক্স রাখা আছে। নাইট্রোজেন গ্যাসভর্তি সেই বাক্সের মধ্যে রয়েছে দুটি সংবিধানও। সম্ভবত পৃথিবীতে আর কোনো দেশের সংবিধান এত যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করা হয়নি। কিন্তু কেন এত তৎপরতা? তার কারণ লুকিয়ে রয়েছে এই সংবিধান তৈরির ইতিহাসের মধ্যে।
ভারতের সংবিধান কেবলমাত্র কতগুলো ধারা, উপধারা আর তফশিলের যোগফল নয়। ভারতের সংবিধান একটি পরিপূর্ণ শিল্পকর্ম। যে শিল্পের মূল কাণ্ডারি নন্দলাল বসু। সংবিধান সংসদের পক্ষ থেকে ১৯৫০ সালে সংবিধানের তিনটি কপি তৈরি করা হয়েছিল। একটি ছিল ছাপা হরফের কপি। সেটি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্যই তৈরি। বাকি দুটি কপি ছিল সম্পূর্ণ হাতে লেখা। ইংরেজি এবং হিন্দিতে লেখা সেই দুটি কপির প্রতিটি অক্ষর লিখেছিলেন প্রেমবিহারী নারায়ণ রাইজাদা। আর তার পাতায় পাতায় অলঙ্করণ করেছিলেন নন্দলাল বসু এবং শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্ররা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রঙে আঁকা হয়েছিল অলঙ্করণের প্রতিটা ছবি। আর ক্যালিগ্রাফিও করা হয়েছিল একেবারে স্বদেশি কালিতে।
১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি, সংবিধান সংসদের শেষ অধিবেশন। আর সেইদিন সকাল থেকেই দিল্লির আকাশের মুখ গম্ভীর। অধিবেশন শুরু হতেই সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে। আর তখনই সংবিধান সংসদের প্রধান ডঃ আম্বেদকরের মাথায় আসে একটি নতুন সমস্যার কথা। প্রাকৃতিক রঙের অলঙ্করণ এবং ক্যালিগ্রাফি দিয়ে তৈরি এত সুন্দর একটি সংবিধান যদি কোনোদিন প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? আর তাই সেদিনের সভার আলোচনায় যুক্ত হয় এই প্রসঙ্গটিও। ঠিক হল, যেভাবে মমি সংরক্ষণ করে রাখা হয়, সেভাবেই এই সংবিধান সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভারতের সংবিধান সংসদের কাছ থেকে বায়না পাওয়ার পরেই কাজ শুরু করে দিয়েছিল গেটি ইনস্টিটিউট। ঠিক কেমন বাক্স তৈরি হবে, তা নিয়ে গবেষণার দায়িত্ব পড়ে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ডঃ সিন মাইকাবার কাঁধে। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হয় মাসখানেকের মধ্যেই। ততদিনে স্বাধীন ভারতের প্রথম পরিপূর্ণ সরকার তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু অবশ্য মমি সংরক্ষণের মতো সংবিধান সংরক্ষণের বিষয়ে সম্মতি জানালেন। কিন্তু তাঁর কথা মতো এবার এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরিকে। ওদিকে গেটি ইনস্টিটিউট ততদিনে কাজ অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছে। তাঁরাও তাই বায়না প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে রাজি হলেন না। এদিকে ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে ডঃ হরি কিষানও তাঁর মতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতায় সমস্যার মীমাংসা হল। তবে তাও ১৯৯৩ সালে। আশার কথা এই যে ততদিনেও সংবিধানের পাতায় কোনো ক্ষতি হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে গেটি ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরি একসঙ্গেই এই কাজের দায়িত্ব পেল। দুই সংস্থাই অবশ্য ততদিনে নিজেদের মডেল তৈরি করে ফেলেছিল। আর ডঃ মাইকাবা এবং ডঃ হরি কিষানের মডেলের খুব বেশি পার্থক্যও ছিল না। ১৯৯৫ সালের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় সেই বিশেষ বাক্সদুটি। সেই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন নাইট্রোজেন ভর্তি বাক্সে জায়গা পায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সংবিধানের দুটি কপি। ৭৩ বছরের জন্য বাক্সদুটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারপর তাদের আবার পরিবর্তন করতে হবে। শুধু দুঃখের বিষয় এই যে, বাক্সবন্দি এই দুই সংবিধানের পাতায় পাতায় যে অলঙ্করণ আর ক্যালিগ্রাফি রয়েছে, তার পাতা উলটে দেখতে পারবেন না কেউই।
Powered by Froala Editor