আরব সাগর কত না রূপকথার সাক্ষী থেকেছে! যতবার পাথরের গায়ে, রোদে তেতে ওঠা গরম বালির ওপর ঠান্ডা ঢেউ এসে পড়ে, ততবারই ফিরে ফিরে আসে সেইসব অতীতের কাহিনি। চোখের সামনে তৈরি হয়েছে এক স্বপ্নের নগরী। সেই কবে থেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন ভাগ্য বদলের আশায় এখানে পা রেখেছে। কথায় বলে ‘মুম্বই মেরি জান’! এই শহর নাকি কাউকে ফেরায় না। কিন্তু শহরটা তো ইতিহাসও তৈরি করতে জানে! গিরগাঁও চৌপট্টি বিচের কাছে চারনি রোডে যে বিশাল সাদা বাড়িটা রয়েছে, ওই বাড়িটাই তো মুম্বইয়ের মাথায় পরিয়ে রেখেছে কোহিনুর। ১০০ বছর পেরিয়েও আভিজাত্যে জ্বলজ্বল করছে রয়্যাল অপেরা হাউজ। এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র জীবিত অপেরা হাউজ…
ভেতরে ঢুকলে মনে হবে যেন এক টুকরো ব্রিটিশ রাজ শাসনের সময় হাজির হয়েছেন। সেই ঝাঁ চকচকে সাদা মার্বেলের মেঝে, সাদা দেওয়াল। সোনালি কারুকাজ করা নকশা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মার্বেলের নারীমূর্তি। আরেকটু ভেতরে গেলেই সামনে, দুই পাশে সার দিয়ে রাখা লাল চেয়ার। আর তাদের সামনে আসল রঙ্গমঞ্চ। ঠিক যেন সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা কোনো দৃশ্য। বাস্তবিকই, রয়্যাল অপেরা হাউজের ছবি সিনেমার থেকে কম নয়। এর সঙ্গেই যে জড়িয়ে আছে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক জানা অজানা গল্পের।
ব্রিটিশরা ভারতে পাকাপাকিভাবে নিজেদের শাসন কায়েম করে নেওয়ার পর মনের মতো করে দেশটাকে সাজাতে লাগল। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরগুলিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করল তারা। বরাবরের মতো যখন শাসন করার ভাবনা, তখন একটু নতুন করে সাজিয়ে নিলেই তো হয়! এইভাবেই অনেক কিছুর সঙ্গে প্রয়োজন পড়ল বিনোদনেরও। ঠিক হল, বম্বেতে (মুম্বই) তৈরি হবে দেশের প্রথম অপেরা হাউজ। ১৯১২ সালে তৈরি হয় এই বিশাল অপেরা হাউজটি। অবশ্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের হাতে এর শিলান্যাস হয়। সম্ভবত সেইজন্যই এই অপেরা হাউজের নামের আগে ‘রয়্যাল’ শব্দটি বসে যায়।
তবে এই ‘রয়্যাল’ হেরিটেজ পরবর্তীতেও বজায় থাকে। স্বাধীনতার পরে যখন ইংরেজরা চলে যায়, তখন এই অপেরা হাউজের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ওঠে। তখনই এগিয়ে আছে আরেক ‘রয়্যাল’ ব্যক্তি; তবে এবার দেশীয় রাজা। গন্ডালের মহারাজা ভোজরাজ সিংহ গোটা প্রপার্টি নিজের নামে লিজ নিয়ে নেন। তারপর থেকে রমরমিয়ে চলে এই হাউজটি। একটা সময় যে জায়গায় গান্ধীজি সভা করে গেছেন, সেখানেই বলিউডের বিখ্যাত সব সিনেমার শো চলতে থাকে। ঝাঁ চকচকে জায়গা, তার সঙ্গে ইতিহাসের গন্ধ ও আভিজাত্য— সব কিছুর মিশেল এখনও মানুষকে টেনে আনে এখানে। বলিউড অবশ্য আরও একটা কারণে মনে রাখবে চারনি রোডের এই বিশাল সাদা বাড়িটিকে। এই রয়্যাল অপেরা হাউজেই তো আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল লতা মঙ্গেশকরের…
আরও পড়ুন
ঘুরপথে ব্যবসা ভারতে? জল্পনা মুম্বইতে বাইটড্যান্সের নয়া অফিস নিয়ে
সিনেমার জগতে সিঙ্গল স্ক্রিনের লড়াইয়ের গল্প আজকের নয়। সেই আশি-নব্বইয়ের দশক থেকেই একটু একটু করে পড়তির দিকে যাচ্ছিল সব জায়গাই। সেই ঢেউ এসে পড়ল এই হাউজেও। টিকিট বিক্রি কমতে লাগল, দর্শকের সেই ভিড়ও আর দেখা গেল না। ১৯৯১ সালে শেষ ফিল্ম; তারপরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মুম্বই তথা ভারতের ইতিহাসের এক অধ্যায়। অবশ্য অন্যান্য অনেক ইতিহাসের মতো ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়নি এর। ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে একে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভাগ্যিস! আর সেই পদক্ষেপের জন্য আজও নিজের পুরনো ঝাঁ-চকচকে চেহারা অটুট রেখে দাঁড়িয়ে আছে মুম্বইয়ের ‘কোহিনুর’।
আরও পড়ুন
করোনা-প্রতিরোধে, ২৮ বছর পর নার্সের ভূমিকায় ফিরলেন মুম্বইয়ের মেয়র
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মুম্বই-এর সমুদ্রতটে ঝাঁকে ঝাঁকে ফ্লেমিংগো পাখি, উঠছে অভয়ারণ্য তৈরির দাবিও