যৌন নিগ্রহ কাকে বলে? ঠিক কোন সংজ্ঞায় ফেলা যায় শব্দটিকে? আইনি পরিভাষার প্যাঁচে অনেক সময়ই সুবিচার পায় না মানুষ। মুম্বাই হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় যেন তেমনই এক দৃষ্টান্ত তৈরি করে গেল। বিষয়টি নিয়ে এতক্ষণে সারা দেশে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই বিশদ বিবরণের প্রয়োজন নেই। মোদ্দায়, মুম্বাই হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেহেতু সংশ্লিষ্ট শিশুটির পোশাক খোলা হয়নি, তাই এই ঘটনাটিকে যৌন নিগ্রহ বলা চলে না।
বেশ কতগুলি প্রশ্নকে সামনে তুলে আনছে এই বিতর্কিত রায়। ২০১২ সালে প্রোটেকশন অফ চাইল্ড ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স বা পসকো আইন তৈরির মূল নীতিই কি শব্দের মারপ্যাঁচে লঙ্ঘিত হল না? হ্যাঁ, আইনি ধারার যে ব্যাখ্যা বিচারক পুষ্প গনেড়িওয়ালা করেছেন, তার মধ্যে ব্যাকরণগত কোনো ভুল নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তি ১২ বছরের বালিকার পোশাকের উপর থেকেই তার স্তনে হাত দিয়েছে। পোশাক খুলে ফেলেনি বা তার ভিতরে হাত দেয়নি। অন্তত তেমন অভিযোগ জানানো হয়নি। তাই ‘স্পর্শ’ করা হয়নি। তবে দেশের বাস্তব প্রেক্ষিতের দিকে তাকালে একটু অদ্ভুত লাগে।
শিশুদের যৌন নিগ্রহের বিষয়টি প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে একটু আলাদা। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময় নানা ধরণের মানসিক জটিলতা চলতেই থাকে। এই সমস্তকিছু মাথায় নিয়ে কীভাবে একটি অপরাধের মাত্রা বিচার করা যায়, তা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক থেকে সামাজিক কর্মীরা কেউই স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। তবে বাস্তবে প্রতিনিয়ত শিশুদের, বিশেষ করে বালিকাদের যে ধরণের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাতে স্বাভাবিক বিকাশ বাধা পায় সবসময়। আর ছোটোবেলার সেইসব অভিজ্ঞতা তাড়া করে বেড়ায় সারা জীবন। এই পরিস্থিতি বদলাতেই তো পসকো আইনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু শব্দের মারপ্যাঁচে অপরাধের মাত্রা নির্ণয় করতে গেলে সেই উদ্দেশ্য কতদূর সফল হবে, প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রশ্ন উঠছে অন্য একটি বিষয় নিয়েও। ঘটনাচক্রে নিগৃহীতা বালিকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। আর এখানেই নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। কাশ্মীর থেকে হাথরাস, সংখ্যালঘু এবং দলিতদের উপর উচ্চবর্ণের যৌন নিগ্রহ, এমনকি ধর্ষণের ঘটনা যেন এখন বেশ গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ধর্ষকের মুক্তির দাবিতে আদালত চত্ত্বরে মিছিল দেখে অবাক লাগলেও, অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। না, সংবিধান লিখিতভাবে সাম্যের কথা বললেও তাঁদের নিরাপত্তার কোনো অধিকার বোধহয় সত্যিই নেই। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও আমরা সেই নিরাপত্তা দিতে শিখিনি। এবার কি সেই ধর্মবিদ্বেষের ছায়াই পড়ল আদালতের উপর? বিচারপতি পুষ্প গনেড়িওয়ালা অবশ্য রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন, পসকো আইনে দোষী না হলেও আইপিসি ৩৫৪ এবং ৩৪২ ধারা অনুযায়ী শ্লীলতাহানির দায়ে দোষী অভিযুক্ত ব্যক্তি। কিন্তু আইপিসি-তে শিশুদের জন্য আলাদাভাবে কোনো ধারা তৈরি করা হয়নি। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছিল পসকো আইন। বিচারপতি কি কোথাও সেই মৌলিক বিষয়টিকেই বাদ দিয়ে দিলেন না? নিগৃহীতা যে এখানে একজন শিশু, সেটাই তো মনে রাখার প্রয়োজন ছিল সবার আগে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মুম্বাইয়ে নৃশংস যৌন নির্যাতনের শিকার পথকুকুর, এ কোন সভ্যতায় বাস আমাদের?