কোন দেশের উন্নয়নের মাপকাঠির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগই শিক্ষা। ভারত সহ গোটা উপমহাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণও সঠিক শিক্ষার অভাব – এমন মনে করেন অনেকেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের একটা বৃহৎ অংশ আজও বইয়ের বদলে আপন করে নেয় শিশুশ্রমের পাঠ। কিন্তু সেখানেই এক ব্যতিক্রমী ভাবনাকে সত্যি করে তুলেছেন মুম্বইয়ের বীণা শেঠ লস্করি। তাঁর এই অভাবনীয় উদ্যোগের পিছনে আছে বহু পরিশ্রমের ইতিহাস। এই উদ্যোগটি এককথায় প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামোতে এক বিপ্লব ঘটিয়েছে।
বছর তিরিশ আগেও এমন ভাবনার জন্ম হয়নি মুম্বইতে। অনেকগুলো ছোট-ছোট ছেলেমেয়ের উৎসুক চোখ স্কুলের বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত, খালি পায়ে এগিয়ে যেত বাসগুলোর দিকে। স্কুলের ইউনিফর্ম থেকে ক্লাসরুম তাদের কাছে স্বপ্নের চেয়ে কম কিছু ছিল না। সারাদিন তাদের কাটত চায়ের দোকান, জুতোর দোকান, কারখানাগুলিতে। খিদের পেট আর স্বপ্নের চোখগুলোর জন্য এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে আসেন বীণা। শিশু মনোবিজ্ঞানে স্নাতক বীণার মস্তিষ্কপ্রসূত এই উদ্যোগটিতে বাসই তাদের কাছে স্বপ্নের স্কুলবাড়ি। যে বাসের সিঁড়িটুকু ছিল কল্পনাতীত, আজ তাই তাদের কাছে অবাধ। প্রায় লক্ষাধিক শিশুর শিক্ষার দায়িত্বে আজ বীণা ও তাঁর টিম। বর্তমানে পুণে ও মুম্বইতে এই ব্যবস্থা শতাধিক কেন্দ্রে চলছে। যারা স্বাভাবিক পঠনপাঠনের খরচের ভার বইতে অক্ষম, তেমন অসংখ্য শিশুর শিক্ষার ভার এখন তাঁদের হাতেই।
প্রায় ৩১ বছরের পথচলার শুরুটা এত সহজ ছিল না। ১৯৮৮ সালে মাত্র ২৫ জন শিশুকে শুরু 'ডোর স্টেপ স্কুল'-এর যাত্রা। কোলাবার কাফে প্যারেডেই শুরু এই স্বপ্নের। সেই সময় শিশুদের প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো কারখানা, দোকানে কাজে জড়িত ছিল। প্রায় ১০ বছর একার হাতেই গোটাটা সামলেছিলেন তিনি। ১৯৯৮-তে আসে 'স্কুল অন হুইল'-এর ভাবনা। এখন তাদের ৭টি স্কুলবাস গোটা মুম্বই জুড়ে ঘুড়ে বেড়ায়। বাস গুলির ভিতরটি সুসজ্জিত ক্লাসরুমের মতোই। বাসগুলিকে দেখা মাত্র ছু্টে আসে শিশুরা। ৮-১৪ বছরের এই খুদেদের গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি শেখানো হয়, হাতে ধরে শেখানো হয় কম্পিউটারও। প্রার আড়াই ঘণ্টার এই ক্লাসগুলিতে ছাত্রদের উৎসাহের কোনো কমতি থাকে না।
মুম্বইয়ের একমাত্র বোরিভেলিতেই 'স্কুল অন হুইল'-এর একটি শাখা শুধুমাত্র উপজাতীয় শিশুদের পাঠ দেয়। যারা কিনা মূলত আসে নিকটবর্তী গ্রাম, মফস্বলগুলো থেকেই। এই সমস্ত শিশুদের কাছে এটি যেন একপ্রকার সব পেয়েছির দেশ। সাধারণ স্কুলের নানা সমস্যা তাদের কাছে শিক্ষার বাঁধা হয়ে ওঠেনি শুধুমাত্র স্কুল অন হুইলসের জন্যই।
মুম্বই ও পুণে মিলিয়ে প্রায় লক্ষাধিক শিশুর ভবিষ্যতের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে 'ডোর স্টেপ স্কুল' ও 'স্কুল অন হুইল'। এখানে ৫০০-রও বেশি শিক্ষক দৈনিক পাঠদান করেন, যাঁদের বেশিরভাগই এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তাঁরা নিজেরা এই স্কুলেই পড়াশুনো শেষ করে তাদের আগামী প্রজন্মকেও নিয়ে এসেছেন এখানেই। যদিও এখানে শিক্ষাদানের আগে সেই সব মহিলাদের কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
দরিদ্র পরিবার হলেও শিক্ষাই যে শেষকথা, সর্বশেষ অগ্রাধিকার তা বারবার বলেছেন বীণা। এই উদ্যোগের কারিগর বলেছিলেন, 'যদি শিশুরা স্কুলে যেতে না পারে, তবে আমরা কেন তাদের দোরগোড়ায় স্কুলকে নিয়ে যাব না?'