মোট বওয়াই একমাত্র পেশা, তাই গাধা বা খচ্চরের নামে ডাকা হয় মহিলাদের

মেলিয়ার অশ্বতর মহিলা

স্পেনের ছোট শহর মেলিয়া। যেখানে মহিলারা প্রতিদিন অতিরিক্ত ওজনের বোঝা বয়ে পার করে দেন স্প্যানিশ এনক্লেভ ও মরক্কোর বর্ডার। এনারাই মেলিয়ার অশ্বতর মহিলা বা মিউল ওয়েমেন অফ মেলিয়া নামে পরিচিত। উত্তর আফ্রিকায় জিনিসপত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ এই শহর যেখান থেকে মহিলাদের সঙ্গে পণ্য পাঠাতে পারলে তা নিশুল্কে রপ্তানি হয় মরক্কোতে। মহিলারা হাসিমুখেই লড়ে চলেছেন বাঁচার এই লড়াই।

পর্টিডোরার বোঝা

আঞ্চলিক ভাষায় এই মহিলাদের বলা হয়ে থাকে পর্টিডোরা। ভোর রাতে বর্ডারে যখন ট্রাক ঢোকে, আলাদা আলাদা ভাবে দুটি লাইন পড়ে পুরুষ ও মহিলাদের। বোঝা সংগ্রহ করার লাইন। মহিলারা সুযোগ পান প্রথমে। তাঁরা অধিকাংশই দুটি করে বোঝা নেন, একটি পিঠে এবং একটি তাঁদের হাতে বানানো স্কেট বোর্ডের উপর(পাহাড়ে ওঠার সুবিধার্থে)। কোনও বোঝার ওজন ষাট কেজির বেশি হলে তা রেখে দেওয়া হয় পুরুষদের জন্য।

অবারিত দ্বার

ছ’মিটার উঁচু বেড়ায় ঘেরা এই শহর এক এবং অদ্বিতীয় এর বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে। বর্ডারে যানবাহনে নিষেধাজ্ঞা ন্যূনতম। এখানে চালানে পাঠানো হয় পুরোনো কাপড়-জামা, ফেব্রিকের থান, প্রসাধনী এবং গৃহস্থালির সামগ্রী। যা মূলত ছড়িয়ে পড়ে মরক্কো এবং সংলগ্ন অঞ্চলের বাজারে। একজন পর্টিডোরা যতক্ষণ তাঁর পিঠে মাল বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন ততক্ষণ সেই বোঝা তাঁর ব্যক্তিগত এবং মরক্কোয় তাঁর কোনও শুল্ক লাগবে না।

নোরার সংসার

গত ১৬ বছর যাবত নোরা এল কুকু একজন পর্টিডোরার কাজ করে চলেছেন। নোরার বয়স এখন ৪৩। বারিও চিনোর একটি ছোট্ট আস্তানায় কষ্টে বেড়ে উঠছে তাঁর অভাবী সংসার। ছয় সন্তানের দায়িত্ব মাথায় বিধবা নোরার জীবন এখন মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়ি ভাড়া থেকে সন্তানদের বেড়ে ওঠার সমস্ত খরচ তাঁর একার কাঁধে। অতএব এই কাজ ছাড়া কোনো গতি নেই তাঁর।

অসম বণ্টন

শ্রমিকসংঘ কর্মী আব্দুল আদার এল ফুঞ্জি একজন মরক্কো নিবাসী। সীমান্ত এলাকার গরিব ও দুঃস্থ মানুষদের উপর শোষনের বিরুদ্ধে তিনি নথিপত্র একত্র করছেন। সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসের দরুণ সাত বা আট বছর বয়সে তিনি প্রথম দেখেন পর্টিডোরাদের। চাকরি নেই, অর্থ নেই অতএব রোজের খাবারটুকু আশ্বস্ত করতে একমাত্র ভরসা এই জিনিস পাচার। এইভাবে পাচারকারীরা কয়েক মিলিয়ান ইউরো রোজকার করে নেয় অথচ আলো জ্বলে না নোরাদের মতো শ্রমিকদের সংসারে।

ভোরের মেলিয়া

যেকোনো সাধারণ দিনে বুরিও চিনো বর্ডার খোলা হয় ভোরবেলা তিনঘণ্টার জন্য। এইসময় প্রায় হাজার তিনেক মানুষ সেখানে জড়ো হন বর্ডার পেরিয়ে মালপত্র বয়ে আনতে। ভোর তিনটেয় উঠে কেউ কেউ প্রার্থনা সেরে, স্নান খাওয়া করে, শিশুদের তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়ে ছুটে এসে সামনের সারিতে লাইন দেন যাতে গেট খুললেই তাঁরা প্রথম দিকে ঢুকে পড়তে পারেন এবং একাধিক যাত্রা সম্পন্ন করতে সক্ষম হন একইদিনে।

বোঝার উপর শাকের আঁটি

মেলিয়া পৌঁছে পর্টিডোরাদের দাঁড়াতে হয় একটি লাইনে। যে লাইন থেকে এক এক করে প্রত্যেকে সুযোগ পান বোঝা নিয়ে আসার। গার্ডদের সঙ্গে সখ্য থাকলে তাঁরা একটির জায়গায় দুটি বোঝা নিতে দেন তাঁদের। একটি পিঠে ও অপরটি হাতে বানানো স্কেটবোর্ডে। মাল পৌঁছে দিয়ে তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য টাকা পান কিন্তু তার আগে মিলিয়ে নেওয়া হয় জিনিসপত্র কিছু চুরি অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা।

চাপান-উতোর

মহম্মদ আবদুল কাদার একজন পুরোনো কাপড় ব্যবসায়ী। তিনি ইউরোপ থেকে পুরোনো কাপড় আনিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিক্রি করেন এইসব মালপত্র। বন্দর এলাকায় অন্যতম বড় গুদামটি তাঁর। তাঁর মতে ব্যবসায়ীরা এবং মেলিয়ার পৌরসভা নিঃসন্দেহে লাভ করে প্রচুর। কিন্তু এর তিনগুণ লাভ পায় সরকার। লাভের দিক থেকে কোনও দ্বন্দ্ব না থাকলেও এই ব্যবসায় লাভের টাকা সঠিক বণ্টন হয় না নিচু স্তর পর্যন্ত।

কমতে পারে কর

আব্দুল মালিক আল মাখানি স্পেনের প্রথম মুসলিম প্রিফেক্ট যিনি মিউল ওয়েমেনদের ব্যাপারে মুখ খুললেন। বললেন সরকার এই অভ্যাসকে সহ্য করে গেলেও কোনোদিন অনুমোদন দেবে না। তিনি বলেন তাঁর ব্যক্তিগত মতে এটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অমানবিক এবং কেবল আর্থিক সংকট থেকে বাঁচার উপায়। মরক্কো চেষ্টা করছে কর আরও কমিয়ে জিনিসের দাম কমিয়ে আনার। সেক্ষেত্রে আমদানি মেলিয়ার ভায়া না হয়ে সরাসরি মরক্কোতে হবে।

দরজা খোলার অপেক্ষায়

বিনা নোটিশে বর্ডার বন্ধ থাকার দরুন দু’বেলা খাবার জুটছিল না নোরা এল কুকুদের ঘরে। অভাবী এই পরিবারগুলির একমাত্র ভরসাই মোট বওয়া। আব্দুল কাদার আল ফুঞ্জি তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় যোগাযোগ করে একটি ফান্ড জোগাড় করেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। ফুড ইন্ডাস্ট্রিগুলি পাস্তা ও দুধ পাঠায় পর্টিডোরাদের জন্য। যদিও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে না হওয়ায় মাত্র কিছু পরিবারই পায় এই সাহায্য। নোরারা এখন তাকিয়ে রয়েছে কাঁটাতারের দরজা খোলার অপেক্ষায়।

Latest News See More