ইউরোপের ক্লাবে খেলা প্রথম ভারতীয় ফুটবলার; কলকাতা মনে রেখেছে এই বাঙালিকে?

১৯৩৬ সাল। স্কটল্যান্ডের মাটিতে হ্যামিলটন অ্যাসিসের বিরুদ্ধে নামতে চলেছে সেল্টিক এফসি। যতই ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হোক, ফুটবলের টানটান উত্তেজনা থাকবে না সেখানে তা কি হয়! একে একে দুই দলের খেলোয়াড়রা মাঠে নামলেন। স্টেডিয়ামে খেলে গেল সেল্টিকের চিরপরিচিত সবুজ-সাদা রং। হঠাৎই একটু যেন খটকা লাগল। সেল্টিকের খেলোয়াড়দের একজনকে দেখে স্বদেশীয় বলে মনে হল না স্কটিশদের। তার ওপর আশ্চর্যের ঘটনা, খেলোয়াড়টির পায়ে কোনো বুট নেই! বরং শক্ত করে বাঁধা রয়েছে ব্যান্ডেজ। এভাবে খেলবে এই ছেলেটি! খেলা শুরু হতে না হতেই যে মাঠে পড়ে যাবে! কোথা থেকে এসেছে এ? 

এমন হাজারো প্রশ্নের মধ্যে শুরু হল খেলা। যত সময় গড়াতে লাগল, দর্শকদের চোখ কপালে উঠে গেল। এ কি জাদু দেখাতে শুরু করেছে সেল্টিকের বুট-না পরা ছেলেটি! তাবড় বুট পরিহিত খেলোয়াড়দের মাঝখান দিয়ে অনায়াস দক্ষতায় বল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। উইং ধরে সেই দৌড় দেখে স্টেডিয়ামও চিৎকার করে উঠল। হ্যামিলটন অ্যাসিসের জালে একের পর এক বল জড়াতে লাগলেন সেল্টিকের খেলোয়াড়রা। ম্যাচটি তাঁরা জিতলেন ৫-১ ব্যবধানে। সমস্ত কাগজের পাতায় উঠে এল সেল্টিকের বুট-না পরা ছেলেটির ছবি। ‘মহম্মদ সালিম ডিড আ স্প্লেনডিড জব!’ ইতিহাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল আগেই। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এই প্রথম কোনো খেলোয়াড় ইউরোপের ক্লাবের হয়ে মাঠে নামলেন। মহম্মদ সালিম যেন জীবন্ত কিংবদন্তি তখন… 

আরও বেশ কিছু বছর আগের কথা। ১৯১১ সাল। আইএফএ শিল্ডের ফাইনাল ম্যাচ। ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে মোহনবাগান। একদিকে বুট পরা ব্রিটিশ সাহেব; অন্যদিকে ১১ জন বাঙালি, খালি পায়ে। বাকিটা নতুন করে বলার আর দরকার আছে কি? ১৯১১-এর সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে। বুট ছাড়া, স্রেফ যোগ্যতা আর দক্ষতায় কয়েকজন অখ্যাত বাঙালি ছেলের হাতে ব্রিটিশদের পরাজয়— এ কি স্বাধীনতার লড়াইয়ের থেকে কম কিছু! গোটা বাংলার চেহারাটাই যেন গেল বদলে। বিশেষ করে ফুটবলের মানচিত্রে একটা বদল এল। বদল আনল মোহনবাগানের সেই সোনার টিম… 

এরই মাঝে কলকাতায় বসেছিল বছর সাতেকের একটি ছোট্ট বাঙালি ছেলে, নাম মহম্মদ সালিম। পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না। তবে পায়ে ছিল ফুটবল। গোলাকার জিনিসটির একবার ছোঁয়া পেলেই বদলে যান সালিম। ভেতরে যেন রক্ত টগবগিয়ে ফুটে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতেই জন্ম নিল ১৯১১-র শিল্ড জয়ের ইতিহাস। সেইদিকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ছোট্ট সালিম। তবে এভাবেও ব্রিটিশদের হারানো যায়! সেদিন থেকেই ঠিক করলেন, বুট পায়ে দেবেন না। খালি পায়েই ফুটবল খেলবেন। এটাই হবে তাঁর প্রতিবাদের রাস্তা। 

শুধু সালিম নন, সেই সময় দাঁড়িয়ে অনেকেই এই স্বপ্ন দেখেছিলেন। বুট না পরে খেলার জেদ ধরেছিলেন তাঁরা। তাঁদেরই প্রতিনিধি হয়ে সামনে আসেন মহম্মদ সালিম। এর পনেরো বছর পর, ১৯২৬ সালে কলকাতা ময়দানে আবির্ভাব হয় তাঁর। ভবানীপুরের চিত্তরঞ্জন স্পোর্টিং ক্লাব দিয়ে যাত্রা শুরু। তবে লক্ষ্য ছিল আরও বড়ো। সালিমের ফুটবলের সহজাত দক্ষতা ও প্রতিভা অচিরেই নজরে পড়ে ময়দানের বড়ো দলগুলোর। স্পোর্টিং ইউনিয়ন, ইস্টবেঙ্গল, আরিয়ান হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি চলে আসেন মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। 

১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ মহামেডানের সোনার বছর। টানা পাঁচবার ক্যালকাটা ফুটবল লিগ জেতে ময়দানের অন্যতম প্রধান এই ক্লাবটি। ১৯৩৬ সালে আইএফএ শিল্ডও ঘরে তোলে তারা। আর এই সবকিছুর পেছনে ছিলেন যে মানুষটি, তাঁর নাম মহম্মদ সালিম। উইং ধরে তাঁর দৌড় বিপক্ষের মনে ভয় ধরিয়ে দিত। খালি পায়ের জাদুতে তখন মুগ্ধ ফুটবল মহল। অবশ্য ১৯৩৬ সালটি সালিমের জীবনেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর। অন্যতম না বলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বললে কি অত্যুক্তি হবে? 

আরও পড়ুন
‘ডিমেনশিয়া’-য় আক্রান্ত কিংবদন্তি ববি চার্লটন, ফুটবলই ঠেলে দিল স্মৃতিভ্রংশের দিকে?

১৯৩৬-এ ভারতের জাতীয় দলে ডাক পান মহম্মদ সালিম। ঠিক ছিল, চিনের অলিম্পিক টিমের সঙ্গে দুটো ম্যাচ হবে। প্রথম ম্যাচটি সালিম খেললেও, দ্বিতীয় ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই বেপাত্তা হয়ে যান তিনি। টিমের এমন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় গেলেন কোথায়? খবরের কাগজে ছাপা হল বিজ্ঞাপন। একটাই অনুরোধ, সালিম যেন চলে আসে জাতীয় দলে। কিন্তু তাঁর দেখা নেই। কোথায় ছিলেন সালিম? 

সালিম তখন জাহাজে। কায়রো হয়ে তাঁর গন্তব্য ইংল্যান্ড। সেখানেই তাঁর এক আত্মীয়, হাশিম থাকে। সালিমের ফুটবল প্রতিভা দেখে তিনি ভাবেন, এই মাপের খেলোয়াড় যদি বিদেশের মাটিতে না খেলে তাহলে তাঁর প্রতিভার প্রতি বিচার হবে না। মূলত হাশিমের আমন্ত্রণেই ইংল্যান্ড যাত্রা সালিমের। বেশ কিছুদিন লন্ডনে থাকার পর তাঁরা চলে এলেন গ্লাসগোতে। হাশিমের নজর ছিল স্কটল্যান্ডের অন্যতম বড়ো দল সেল্টিক এফসি। সেই সময় সেল্টিকের ম্যানেজার ছিলেন উইলি ম্যালি। কলকাতা থেকে এক প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলার এসেছেন, তিনি বুট ছাড়া ফুটবল খেলেন। নিজের দেশে ইংরেজদের হেলায় হারিয়েছেন তিনি। উইলি একবার মুখ তুলে দেখলেন সালিমকে। বুট না পরেই একজন খেলোয়াড় তাঁর পায়ের জাদু দেখাচ্ছে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও একসময় রাজি হলেন উইলি। এবং বিশ্বাস করে তিনি যে একদমই ভুল করেননি, তা প্রমাণিত হল কয়েক মিনিট পরেই। 

সালিমের ফুটবল প্রতিভায় মুগ্ধ সেল্টিকের বাকি ফুটবলার ও কোচেরাও। ঠিক হল, সামনেই দুটো ফ্রেন্ডলি ম্যাচে সালিমকে মাঠে নামানো হবে। ১৯৩৬ সালেই তৈরি হল ইতিহাস। প্রথম বাঙালি এবং ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে ইউরোপের কোনো ক্লাবের হয়ে খেলতে নামেন। অভিষেকেই আপামর সেল্টিক ভক্তদের নজর কাড়েন সালিম। প্রথম ম্যাচের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। গালসটনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচে যেন আরও ধারালো হয়ে উঠলেন সালিম। নিজে গোল না করলেও, সেল্টিকের করা সাতটি গোলের মধ্যে তিনটির পেছনে তাঁর ‘পা’ আছে। 

আরও পড়ুন
শহিদ হওয়ার আগেই ইংরেজ জেলাশাসককে হত্যা, রক্তাক্ত মেদিনীপুরের ফুটবল মাঠ

বিদেশের মাটিতে তাঁর কেরিয়ার যে উজ্জ্বল, তেমনটাই মনে করছিলেন সবাই। সেল্টিক চেয়েছিল, একটা গোটা মরসুমের জন্য তাঁকে সই করাতে। কিন্তু সালিমের যেন আর মন বসল না বিদেশে। দেশের মাটি, ময়দানের মাটি, মহামেডান তাঁকে যে ডাকছে! এভাবে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থেকে লাভ কি! ইতিমধ্যে জার্মানির একটি ক্লাব থেকেও অফার এসেছে। সবকিছু এক তুড়িতে মুছে দিলেন মহম্মদ সালিম। ১৯৩৬-এই ফিরে এলেন বাংলায়। মহামেডানকেই নিজের ক্লাব হিসেবে বেছে নিলেন কেরিয়ারের শেষ পর্যন্ত… 

কথায় বলে, শেষ হইয়েও হইল না শেষ। মহম্মদ সালিমের গল্পের শেষেও জুড়ে আছে আরও একটি অসামান্য ঘটনা। ১৯৮০ সালে মারা যান সালিম। তার আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁর ছেলে, রশিদ আহমেদ একটি চিঠি লেখেন সেল্টিক এফসি-কে। একটা সময় সেখানে রীতিমতো সম্মান পেয়েছিলেন তাঁর বাবা। হয়তো মনে থাকবে না কারোর, তবুও একবার চিঠি দিয়ে বাবার এই অবস্থার কথা তো জানানোই যায়! ইউরোপে খেলা প্রথম ভারতীয় বলে কথা! 

বেশ কয়েকদিন পর একটি চিঠি এল সালিমের ঘরে। ছেলে রশিদ সাক্ষী থাকল এক অদ্ভুত ঘটনার। চিঠিটি এসেছে স্কটল্যান্ডের সেল্টিক এফসি থেকে। মহম্মদ সালিমকে যে তাঁরা ভোলেনি, এখনও ক্লাবের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি, সেই কথাই লিখেছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ। শুধু তাই নয়, কিংবদন্তি এই রাইট উইঙ্গার যাতে সুস্থ হয়ে ওঠেন, তার জন্য টাকাও পাঠিয়েছে তাঁরা। এমনই বিস্ময়, এমনই ইতিহাস তৈরি হয়েছিল মানুষটিকে ঘিরে। কলকাতার ময়দান তাঁকে সারাজীবন মনে রাখবে। মনে রাখবে সেল্টিক ক্লাবও। আমরাও না হয় একটু বুকে আগলে রাখি তাঁকে! 

আরও পড়ুন
আবারও করোনার থাবা ফুটবল মহলে, আক্রান্ত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো

তথ্যসূত্র- 

১) ‘The Untold story of Mohammed Salim, the first Indian Footballer to play for a European Club’, Harsh Murarka, IFTWC
২) ‘A Tribute to Indian Football’s Unknown Hero’, Michelle Alves, Bleacher Report
৩) Mohammed Salim, The Celtic Wiki

Powered by Froala Editor

More From Author See More