ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র মণিমাণিক্য। দেশ মানে তো শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনুভূতি। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সংগ্রামীরা অনায়াসে বুক পেতে দিত ব্রিটিশ পুলিশের বন্দুকের গুলির সামনে। রক্তাক্ত শরীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়েও সোচ্চারে উচ্চারিত হত স্বাধীন ভারতের ধ্বনি। ‘বন্দে মাতরম’-এর শব্দব্রহ্ম যেমন দীর্ঘদিন ধাওয়া করে বেরিয়েছে ইংরেজদের। তেমনই সারা দেশ উদ্বেলিত হত ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-র মন্ত্রে। যার রচয়িতা মুহম্মদ ইকবাল। আর আজ যে সুরে গাওয়া হয় এই গান, তার সুরারোপ করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
মুহম্মদ ইকবালের জন্ম ১৮৭৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে। যা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত। প্রাথমিক শিক্ষালাভ স্কটিশ মিশন কলেজে। ১৮৯৯ সালে যখন স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ করেন, তখনই সাহিত্যিক হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন ইকবাল। ১৯০৪ সালে উর্দুভাষায় রচনা করেন ‘তারানা-এ-হিন্দ’ কবিতাটি। ইকবাল তখন লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজের এক তরুণ অধ্যাপক। পরবর্তীকালে গদর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা লালা হরদয়ালের আমন্ত্রণে উপস্থিত হন এক বিশেষ অনুষ্ঠানে। ‘ইয়ং মেনস খ্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর বিধিনিষেধ ও ঔপনিবেশিক আচরণে ক্ষুব্ধ হরদয়াল পরিকল্পনা করেন ভারতীয়দের নিজস্ব একটি সংগঠনের। যার নাম দেওয়া হয় ‘ইয়ং মেনস ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। তারই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয় ইকবালকে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের মতো দীর্ঘ, একঘেয়ে বক্তৃতা দিতে কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না তিনি। তার বদলে কণ্ঠে ধ্বনিত হল একটি নতুন গান ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’। যদিও ১৬ আগস্টের ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই কবিতাটি প্রাথমিকভাবে রচিত হয়েছিল শিশু-কিশোরমনস্কদের জন্য। কিন্তু অবিলম্বেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অস্ত্র হয়ে ওঠে এর প্রতিটি পংক্তি।
তার প্রায় চল্লিশ বছর পরের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপর্যস্ত ব্রিটিশ-সিংহ। দেশের সাংস্কৃতিক জগতে নতুন ভাবধারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ‘আইপিটিএ’। উদারমনস্ক সকল শিল্পী-সাহিত্যিকদের এক মঞ্চে এনে চিন্তা-চেতনায় বিপ্লব ঘটানোর চলছে প্রস্তুতি। ১৯৪৫ সালে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে অনুরোধ করা হয় ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-য় সুরারোপ করার জন্য। সেই সময় তিনি কাজ করছিলেন খাজা আহমেদ আব্বাসের ‘ধরতি কে লাল’ আর চেতন আনন্দের ‘নিচা নগর’-এর জন্য। প্রথম ছবিটির কাহিনি তৈরি হয়েছিল বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’ নাটক ও কৃষন চন্দরের গল্প অবলম্বনে। সুরারোপের কালে রবিশঙ্করের মনে হয়, ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’-র প্রচলিত সুরটি বড়ো ধীর লয়ের এবং একটি কারুণ্য মিশে আছে তার মধ্যে। সেই কারণে সুরে কিছু পরিবর্তন করেন রবিশঙ্কর। যা নিয়ে আসে আরো বলিষ্ঠ উন্মাদনা। পরবর্তীতে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় গানটি।
শোনা যায়, তিনের দশকে পুনের ইয়েরাওয়াদা জেলে থাকাকালীন গান্ধীজি একশো বারের বেশি গাইতেন ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’। পরে নতুনতর যন্ত্রানুষঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান আর্মড ফোর্স’-এর মিলিটারি পদচারণার সময় বেজে ওঠে এই গান। আর ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রথম মহাকাশচারী রাকেশ শর্মাকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, মহাশূন্য থেকে ভারতের সৌন্দর্য সম্পর্কে, তখন গানের ভাষাতেই দিয়েছিলেন তার উত্তর। আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন কতগুলি সূত্র যেন জুড়ে যায় ইকবালের কবিতার প্রসঙ্গে। ইতিহাস কাজ করে গেছে নিজের মতো। তবুও, এক প্রত্যয়ের জন্ম হয় প্রতিদিন। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দেশ ভারত। বাস্তব আর স্বপ্নের লড়াইয়ে অন্তত এটুকু বিশ্বাস বেঁচে থাকুক। আজ না হোক, কোনো একদিন নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে সেই স্বপ্ন।
আরও পড়ুন
প্রথম অনুষ্ঠান কলকাতায়, 'লয়ের পুতুল' আখ্যা দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর
তথ্যঋণ :
আরও পড়ুন
‘এইডা শিখাইলাম তগো? আমার নাম ডুবাইলি’ – রবিশঙ্কর-বিলায়েতের যুগলবন্দিতে ক্রোধ গুরু আলাউদ্দিনের
Saare Jahan se…, it’s 100 now, The Times of India, 19 April, 2005
Walk the talk with Pandit Ravi Shankar, Shekhar Gupta, (Aired on December 05, 2009), NDTV
‘Sare Jahan se se Achcha’ Was composed by Ravi Shankar!, Subhash K Jha, National Herald, 7 April, 2020
Powered by Froala Editor