নাম শুনে চমকে উঠতেই পারেন। কেননা, 'রেন্ডি'- অর্থ সবারই জানা। আর সেই নামে মসজিদ, তাও আবার খোদ রাজধানী দিল্লির বুকে! এমন ‘অঘটন ঘটল কীভাবে? আর, কেই বা এই ‘রেন্ডি’? তা জানতে হলে অবশ্য উঁকি দিতে হবে ইতিহাসের পাতায়।
উনিশ শতকের প্রারম্ভ। মুঘল বাদশাহদের হুকুমৎ তখন দুর্বল হয়ে এলেও বিলীন হয়নি। ডেভিড অক্টারলনি মুঘল দরবারের ব্রিটিশ প্রতিনিধি। মোট দু-বার তিনি এই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৮০২-০৩ সাল নাগাদ, আর ১৮২২ সালে। মুঘল বাদশাহদের সঙ্গে ওঠাবসা তাঁর। বাদশাহদের রুচি সংস্কৃতি বেশ ভালোই প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর। সমকালীন অনেক ব্রিটিশ-প্রধানই কিন্তু মুঘলি আদবকায়দাকে রপ্ত করেছিলেন আন্তরিকভাবে৷ ধর্ম বদলেছিলেন তো বটেই। তার উদাহরণ সুপ্রচুর। হতে পারে, তাতে সাম্রাজ্য-দখলের গোপন ইচ্ছে ছিল। তবে, পুরোটাই সেই লিপ্সায়, এমনটা মনে হয় না। ওয়ারেন হেস্টিংস নাকি নিজেকে 'ইতিমদ- অল- দৌলাহ্- আমির-অল- মামালিক' নামে পরিচয় দিতে বেশ ভালোইবাসতেন। হ্যাঁ, অনেক ইংরেজই এদেশে এসে মুঘল খানদানি নাম গ্রহণ করেছিলেন। সেটা শুধু 'আমি তোমাদেরই লোক' হয়ে ওঠার ছদ্ম-ইচ্ছে ছিল না। প্রয়োজন ও মিলন - দুটোই একইসঙ্গে ঘটেছিল।
অক্টারলনি সাহেবের কথাতেই ফেরা যাক। মোট ১৩ জন স্ত্রী ছিল তাঁর। সেই তেরোজনকে নিয়ে সাহেব নাকি প্রমোদভ্রমণেও বেরোতেন। এরমধ্যে ত্রয়োদশতমা স্ত্রী মুবারক ছিলেন অক্টারলনির প্রিয়তমা। অক্টারলনির থেকে বয়সে বেশ ছোটো, বুদ্ধিমতী মুবারক বেগম আসলে ছিলেন পুনের একজন নর্তকী। হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অক্টারলনির পত্নী হওয়ার পরে নাম হয়, মুবারক উল- নিসা বেগম। ১৮২৩ সালে তাঁর নামেই দিল্লির হজ কাজি অঞ্চলে একটি মসজিদ গঠিত হয়। চৌরি বাজার মেট্রোস্টেশনে নামলে আজও সেই মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। চৌরি বাজারের একসময়কার নাম নাকি ছিল বাজার-এ-হুসেন, সৌন্দর্যের অঢেল সম্ভার যেখানে। সেই দিল্লিকে আজকের লাটিয়ান্স দিল্লি তখনও আড়াল করেনি। যাহোক, সেখানেই মুবারক বেগমের মসজিদ। কেউ কেউ বলেন বেগম নিজেই খরচাপাতি করে মসজিদ বানিয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন, সাহেব নিজেই ভালোবেসে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোট কথা, নর্তকী বেগম মুবারকের নামাঙ্কিত লাল বালিপাথরের সে মসজিদ অবশ্যই মুঘল জমানার বিরল ঘটনা।
আরও পড়ুন
অ্যান্টিক মূর্তির টোপ দিয়ে স্মাগলারকে অপরহণ, চম্বলের ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল দিল্লিও
ছিলেন বাঈজি নর্তকী, হলেন সাহেবের বেগম। আর শুধু হলেনই না, রীতিমতো জয় করলেন। তাঁকে কেউ কেউ বলতেন জেনারেলি বেগম। সাহেবের ওপর কর্তৃত্ব ভালোই চালাতেন। অন্দরমহলে তাঁর কথাই শেষ কথা। মুবারক বেগমের দুই কন্যাকে কিন্তু অক্টারলনি ইসলাম ধর্মভুক্তই রেখেছিলেন। তবে সাহেব যতই সম্মান দিক, তৎকালীন ব্রিটিশ সমাজে বা মুঘল দরবারেও সম্মানের আসন ছিল না মুবারকের। ব্রিটিশদের কাছে নিজেকে তিনি পরিচিত করতেন, লেডি অক্টারলনি নামে। আর মুঘলদের কাছে নিজেকে বলতেন তিনি -'কুদসিয়া বেগম'। এই উপাধি ব্যবহৃত হত সম্রাটের মায়ের জন্যে। ফলে এপার-ওপার কোথাওই মুবারকের আপ্যায়ন ছিল না। যদি প্রভাবশালী না হতেন, যদি নিজের কর্তৃত্ব কোথাওই কায়েম না করতেন, যদি চিরকাল নিজের অস্তিত্বকে আড়াল করে রাখতেন- তাহলে হয়তো আপ্যায়ন পেতেন। একজন নর্তকীর এভাবে আত্মপ্রকাশ - আজও কি মেনে নেওয়া হয়?
সেসময় অবশ্য নর্তকী বা বাঈজীকে সমাজ অপমানের চোখে দেখত না। বাঈজীরা ছিলেন একান্ত কাঙ্ক্ষিত। নাচ গান কবিতায় ভরে থাকত তাদের শিল্পীজীবন। সেখান থেকে তাদের অবস্থান সরতে থাকে ভারতবর্ষ উপনিবেশে পরিণত হওয়ার পরে। তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা আজ সহজেই মেলে। পরবর্তীতে বাঈজী বা নর্তকীর অর্থান্তর আমরা দেখেছি। অবহেলা ও অসম্মানের জীবনও। তাই আজও কি লোকমুখে মুবারক বেগম – রেন্ডি কা মসজিদ? আর তাতে মুছে যাচ্ছে না মুবারক বেগমের জীবন-ইতিহাসটি? দিল্লি ট্যুরিজমে কি স্থান পায় মসজিদটি? কে জানে?
আরও পড়ুন
এক দশকের প্রকল্পে বদলেছে চেহারা, দিল্লির ‘সুন্দর বাগিচা’-কে স্বীকৃতি ইউনেস্কোর
এভাবে তো কতকিছুই ভুলে যাওয়া চলে। ঠিক যেমন অনেকেই ভুলে গেছেন কলকাতার শহিদ মিনারের পুরনো নাম। ‘অক্টারলনি মনুমেন্ট’। হ্যাঁ, অক্টারলনি সাহেবের নামেই নামাঙ্কিত ছিল এই মিনার। আর তাঁর বেগমের মসজিদ নিয়েই এত কথা। এভাবেই ইতিহাসের সূত্রে বারবার জুড়ে যায় কলকাতা-দিল্লি। আমরা মনে রাখি না। চাইও না বোধহয়...
ঋণ-
১. 'সায়েবমেম সমাচার' - নিখিল সুর
২. উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য।
আরও পড়ুন
ধাক্কা মেরেই রোজগার তাঁদের, দিনশেষে মদ ও জুয়া – দিল্লির ‘ধাক্কামার’দের গল্প
Powered by Froala Editor