সান্তা যখন মহিলা, আমেরিকায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন মিসেস ক্লজ

সাদা চুল-দাড়ির মধ্যে সদাহাস্যকর এক মুখ। পরনে সাদা কাফযুক্ত লাল ওভারকোট। মাথায় লাল টুপি। পিঠে বিশাল কাপড়ের ঝোলা। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে সেন্ট নিকোলাসকে নিয়েই। সকলের কাছে যার পরিচয় সান্তা ক্লজ নামে। তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ বড়োদিনের আয়োজন। তবে এই পরিচিত চেহারার বাইরে গিয়ে যদি সান্তা একজন মহিলা হতেন? কেমন হত তবে? 

হ্যাঁ, উনিশ শতকের মার্কিন সাহিত্য এমনই এক সান্তার জন্ম দিয়েছিল। যিনি পুরুষ নন, বরং মহিলা। মিসেস ক্লজ (Mrs. Claus)। এই কাল্পনিক চরিত্রকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে। তবে মিসেস ক্লজই হয়ে উঠেছিলেন স্বনির্ভর মার্কিন মহিলাদের, মহিলা আন্দোলনের (Women Right Movement) প্রতীক (Symbol)। তবে মার্কিন সাহিত্য আকস্মিকভাবে জন্ম দেয়নি মিসেস ক্লজের। বরং তার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ কাহিনি। 

সেই গল্পের অনুসন্ধান করার আগে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার আরও একটি বিষয়। আদতে সান্তা বা সেন্ট নিকোলাস ছিলেন একজন সন্ত তথা বিশপ। তবে আজকের পরিচিত সান্তা ক্লজের ছবির সঙ্গে তাঁর চরিত্র মেলাতে গেলে হোঁচট খেতে হবে প্রথমেই। না, লাল পোশাক নয়। বরং, ছেঁড়া-ফাটা জোব্বা পরিহিত শীর্ণকায় সন্তের ছবিই ভেসে উঠবে তাঁর বর্ণনা শুনলে। উনিশ শতকে মার্কিন কার্টুনিস্ট থমাস নাস্ট মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রথম তাঁর স্থূলকায় এক ক্যারিকেচার অঙ্কন করেন। প্রকাশিত ছবিটি সাদা-কালো হলেও, আদতে লাল ওভারকোট-প্যান্ট পরিহিত সান্তা এঁকেছিলেন নাস্ট। নাস্টের সেই কাল্পনিক ক্যারিকেচারই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর সেই জনপ্রিয়তা ধরেই আধুনিক সাহিত্যজগতে ঢুকে পড়েছিলেন সেন্ট নিকোলাস।

ঊনবিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক সেটা। প্রকাশ পেয়েছিল ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুরের কবিতা ‘অ্যাকাউন্ট অফ আ ভিসিট ফ্রম সেন্ট নিকোলাস’। উল্লেখ্য, এর আগে পর্যন্ত সেন্ট নিকোলাস ছিলেন একজন ধর্মীয় চরিত্র। শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয় গ্রিক এবং বাইজেন্টাইন ধর্মেও হুবহু একই ধরনের চরিত্রের বর্ণনা রয়েচেহ। তবে ক্লার্ক মুর তাঁর কবিতায় প্রথমবারের জন্য চরিত্রাঙ্কন করলেন ধর্মনিরপেক্ষ সান্তা ক্লজের। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন পারিবারিক উৎসব উদযাপনের। 

আরও পড়ুন
নরওয়ের বিজ্ঞাপনে সমকামী সান্তাক্লজ, নতুন যুগের ইঙ্গিত?

স্বাভাবিকভাবেই পারিবারিক উদযাপনের কথা উঠলে আবশ্যিকভাবেই চলে আসে পরিবারের কথাও। তবে নিশ্চয়ই সান্তারও পরিবার রয়েছে? হ্যাঁ, এমন একটা চিন্তাভাবনা থেকেই পরবর্তী সাহিত্যিকদের লেখায় উঠে আসে সান্তার পত্নীর কথা। প্রথম তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৮৪৯ সাল প্রকাশিত ধর্মপ্রচারক জেমস রিসের লেখা ‘আ ক্রিসমাস লেজেন্ড’ গল্পে। তবে এই গল্পের মূল চরিত্র ছিলেন আরও একজন মিসেস ক্লজ। যিনি আসলে সান্তার হারিয়ে যাওয়া বড়ো মেয়ে। সান্তার মতোই ছদ্মবেশে স্বামীর সঙ্গে উপহার নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন গৃহস্থে। পরবর্তীতে বিভিন্ন গল্পে সান্তার নাতনি ‘স্নো মেইডেন’-এর কথাও উল্লেখিত হয়েছে। বিশেষত, রাশিয়ায় আজও ক্রিসমাস ইভে সান্তার অন্যতম সঙ্গী হিসাবে দেখা যায় তাঁকে। 

আরও পড়ুন
কোকাকোলার বিজ্ঞাপনেই প্রথম জনপ্রিয় 'লাল পোশাকের' সান্টা ক্লজ

যাই হোক, সান্তার ফ্যামিলি-ট্রি ছেড়ে ফেরা যাক মিসেস ক্লজের কথায়। ১৮৫১ সালে জনপ্রিয় ইয়েল লিটারারি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ‘মিসেস সান্তা ক্লজ’ নামের একটি গল্প। সেই গল্পে দেখানো হয়, সান্তা ক্লজ বাড়ি বাড়ি ছোট্ট কিশোর-কিশোরীদের উপহার দিতে গেলেও, এই গোটা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন তাঁর স্ত্রী মিসেস ক্লজ। উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং সজ্জার দায়ভারও থাকে তাঁর কাঁধেই। সান্তা, অসংখ্য বামন এলফ এবং গোটা কয়েক বলগা হরিণ নিয়ে তাঁর সংসার।

আরও পড়ুন
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, কৃষ্ণাঙ্গ সান্তা ক্লজের জন্ম দিয়েছিল মার্কিন প্রদেশ

তবে নিছক গল্প ছিল না ‘মিসেস ক্লজ’। বরং, এই গল্পে প্রতিফলিত হয়েছিল আমেরিকান মহিলাদের বাস্তব পরিস্থিতির ছবি। উৎসবের মূল আয়োজক যে তাঁরাই। অথচ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁদের কতটুকুই বা স্বীকৃতি দিত? ১৮৬৪ সালে হার্পার’স ম্যাগাজিনে এই চরিত্রটির ওপর ভিত্তি করেই প্রকাশিত হয় আরও একটি জনপ্রিয় কমিক্স। কার্টুনিস্ট রবার্ট ক্লারের অঙ্কনে পূর্ণাঙ্গ রূপ পান মিসেস সান্তা। তার পরনে ছিল লাল শর্ট এবং লাল পেটিকোট। সব মিলিয়ে এই চিত্রায়ন মহিলা ক্ষমতায়ন এবং আধুনিক সময়কেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিল। 

আর তা নিয়েই দ্বিবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন সমাজ। সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার অভিযোগ উঠেছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। সেইসঙ্গে সমান তালেই চেষ্টা চলত সান্তা ক্লজের এই ‘নেতিবাচক’ উপস্থাপনার কণ্ঠরোধের। 

তবে পাল্টা জনমতও গড়ে উঠেছিল সেসময়। ১৮৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর আরও বেশি করে প্রকাশিত হতে থাকে মিসেস ক্লজের কিংবদন্তি। সত্তরের দশকে মিসেস ক্লজের মধ্যে দিয়ে মহিলাদের ভোটাধিকার, স্বাধীনতার দাবির মতো বিষয়গুলি তুলে আনেন জর্জিয়া গ্রে। তাঁর গল্পে সান্তা ক্লজের সঙ্গে মিসেস ক্লজের সংঘাতও যেন সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন। আদালতেও পিটিশন জমা পরেছিল জর্জিয়ার এই গল্পের বিরুদ্ধে। সেসময় পাশে দাঁড়ায় মহিলা ম্যাগাজিন ‘গডে’স লেডি’স বুক’। পাঠক-পাঠিকাদের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য পথে নেমেছিলেন সেই পত্রিকার খোদ সম্পাদিকা সারা হেল। 

এই আন্দোলনকে জিইয়ে রাখতে ১৮৮৪ সালে অভিনব সাহিত্যকর্ম রচনা মার্কিন লেখিকা তথা ভোটাধিকার কর্মী ক্যাথরিন লি বেটস। ‘গুডি সান্তা ক্লজ’-নামের সেই গল্প ছাপিয়ে যায় তার সমস্ত পূর্বসূরিকেই। মিসেস ক্লজ সেখানে এক স্বতন্ত্র, স্বাধীন, স্বনির্ভর, স্পষ্টভাষী মহিলা। তাঁর স্বামী রয়েছেন। অবশ্য তিনি ক্রিসমাসের সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে মত্ত থাকেন উৎসব উপভোগ এবং পেটপুজোয়। অন্যদিকে সমস্ত আয়োজনের পর স্লেজ গাড়িতে চেপে একাই উপহার দিতে বেরিয়ে পড়েন গুডি ক্লজ। যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে— এই প্রবাদবাক্যকেই যেন মনে করিয়ে দিয়েছিল ক্যাথরিনের গুডি ক্লজ। দেখিয়েছিল সংসার সামলে বাইরের সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে পারেন মহিলারা।

এই গল্প প্রকাশের পর থেকেই মার্কিন সমাজ ধীরে ধীরে সাম্যের পথে হাঁটা শুরু করে। বদলায় প্রচলিত ধ্যানধারণাও। বিশ শতকের শুরুতেই ভোটাধিকার পান মার্কিন মহিলারা। মহিলা অধিকার আন্দোলনের সেই জয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে অলিখিতভাবেই অন্যতম চরিত্র ছিলেন মিসেস ক্লজ। অবশ্য, বিশ শতকে মহিলারা স্বতন্ত্রতা পেলেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় মিসেস ক্লজের কিংবদন্তি। আজকের সময়ে ক্রিসমাস নিয়ে মাতামাতি বেড়েছে আরও। কিন্তু বিস্মৃতির আড়ালেই থেকে গেছেন এমন এক আকর্ষণীয় চরিত্র। এও কি বৈষম্য নয়?

তথ্যসূত্রঃ
১. How 19th-century writings about Mrs Santa Claus embodied debates about gender equality, Maura Ives, The Conversation
২. উইকিপিডিয়া, মিসেস ক্লজ
৩. How Mrs. Claus embodied 19th-century debates about women’s rights, Maura Ives, San Antonio Report

Powered by Froala Editor