শিরোনাম পর্দায় ভেসে উঠলে, ক্যামেরা জুম-আউট করে 'কোরাস' শব্দটি থেকে। পরের শটে, কথক(রবি ঘোষ) চরিত্রের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরিক্ষার সূত্রপাত। গান শেষে দুর্গের দেখা মেলে। চারদিকে ধু-ধু প্রান্তর। বিচ্ছিন্নতা বোঝাতে এই ইমেজের প্রয়োগ। পরবর্তীতে পরিচয় লিপি ভেসে ওঠে। পরিচয়লিপির ফাঁকে-ফাঁকে, মানুষের ভয়াবহ দুরাবস্থার স্থিরচিত্র ভেসে উঠতে থাকে। পুড়িয়ে দেওয়া বাস-মারমুখী জনতা। শ্রীসেন ওঁর কলকাতা চিত্র-ত্রয়ীতে স্থিরচিত্র মুহুর্মুহু ব্যবহার করলেও, পরিচয়লিপিতে এর আগে করেননি।
কাট করে চলে আসেন সাদা পর্দায়। কালোছাপা হরফের বিজ্ঞাপনে:
SITUATIONS VACANT
USE PRESCRIBED FORMS TO APPLY
TWO RUPEES PER FORM,
এরপরে ক্যামেরা এক ঝলক দুর্গ দেখিয়ে ভেতরে বসা টেলিফোনে নির্দেশরত এক ব্যক্তিকে ধরে। কাট টু অফিসে কর্মরত মানুষজন। অফিস কেরানিদের দেখা যায়, ট্রলিশটে। একবার ডান থেকে বাঁয়ে, অন্যবার বাঁদিক থেকে ডানদিকে। ক্যামেরা মুভমেন্টে ছন্দের সৃষ্টি।
ছবিতে অধিকাংশ চরিত্রদের নাম উহ্য। যা বিমূর্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বের পরিচায়ক। একাধিক ফ্যান্টাসি এই ছবির ভিতরে বিরাজমান। দুর্গের, তিরিশ-হাজারের। কথক, বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসির মেলবন্ধনকারী। এর প্রমাণ ছবির ট্যাগলাইন, কোরাস-একটি আধুনিক ফ্যান্টাসি। নাটকে সাধারণত কথকের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্ত এই ছবিতে কথকের চরিত্র তিনবার আসে। ভিন্নভিন্ন বেশভূষায়, ভিন্ন সময়ে। বাস্তব থেকে দর্শককে ফ্যান্টাসির জগৎে নিয়ে যেতে।
দুর্গের ভিতর বসে মালিক/ম্যানেজমেন্ট কাজ-কর্ম পরিচালনা করে। তা সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন। উঁচু-উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সান্ত্রিসেপাই টহল দেয় তার বাইরে। এটি একটি ফ্যান্টাসি। মালিক-শ্রেণির অবস্থান বোঝাতে। দুর্গের চারপাশে জনমানবহীনতার বৃদ্ধি ঘটাতে, মিড-লং থেকে লং শটে স্থানান্তর। দুর্গের মাথায় রেডার ঘুরতে থাকে যান্ত্রিক অনুসঙ্গের সঙ্গে। দুর্গের ফ্যান্টাসির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ৩০,০০০-এর ফ্যান্টাসি। এই সংখ্যা বাঁধ-ভাঙা মানুষের প্রতিভূ। এই সংখ্যা শুধু সংখ্যা নয়, এতে সন্ত্রস্ত মালিকপক্ষ থেকে পুলিশ। সন্ত্রাস চালিয়েও কিছু কূল-কিনারা করা যায় না। মালিকপক্ষের ভীতি বেড়ে চলে। জনমানসে আলোড়নের সৃষ্টি। জনতা আর পিছপা নয়, সে লড়তে চায়। রাস্তায়-মাঠে-ঘাটে তাদের দেখা মেলে। তাদের মনোবলের হেতু এই সংখ্যা। যা থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছে। এ যেন স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের বিমূর্ততার প্রতীক।
চাকরিপ্রার্থীদের লাইনের শেষ দেখা যায় না। যেন অনন্ত। লাইন দেওয়া বিষয়টা সেই সময়ের আইকন। লাইন মানে অপেক্ষা। চাকরির জন্য, চাকরি পেলে তার মাইনের লাইন। মাইনে পেলে, রেশন দোকানে খাবারের লাইন। লাইন সেই সময়ের জনমানসে গেড়ে বসেছিল। তার দ্যোতনা ফর্মের দীর্ঘ লাইন।
মিটিং দৃশ্যে মালিক(উৎপল দত্ত) চরিত্র ‘কন্ট্রোল’ বলে চিৎকার করে ওঠে। ফ্রেমে চরিত্রের মুখ স্থায়িত্ব পায়, সাউন্ড-ট্র্যাকে মার্চিং সাউন্ড শোনা যায়। দৃশ্যান্তর না ঘটিয়েও শুধু শব্দ প্রয়োগ দিয়ে পরিচালক, সশস্ত্র বাহিনীর ঈঙ্গিত দেন। যারা বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এবার, বাইরে অপেক্ষারত জনতার মাঝে। যুবক, যুবতী, মাঝবয়সি, প্রৌঢ়, শহুরে, গ্রাম্য, বহুরকম মানুষের ভিড়। সাংবাদিক(শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) এসে ছবি তুলতে শুরু করে। তার মধ্যে কেউ কেউ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, কেউ বোমাবাজি করে। সারিবদ্ধ মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তারপরেও লাইন হয়।
এক যুবতীর সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে দর্শক এসে পৌঁছোয় সেই নারীর দৈনন্দিন জীবনে। মা(গীতা সেন) ও ছোটোবোনকে নিয়ে তার সংসার। মা এক বাড়িতে রান্না করেন। সে খানকতক টিউশনি করে। এই সিকোয়েন্সের শুরু সংবাদপত্রের দফতরে। সাংবাদিক ও সম্পাদক রেকর্ডিং শুনছে। এরপর যার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাকে দেখানো। আবার দফতরে ফেরত আসা। এই দৃশ্যসমষ্টির বৈশিষ্ট্য, দৃশ্যান্তর ঘটলেও পিছনে একই কণ্ঠস্বর শোনা যেতে থাকে। পরে যুবতীর কাহিনি ফিরে আসে। তার গুছিয়ে রাখা আবেদনপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তার বোন ঝুমুরের অসাবধানতাবশত। কালি পড়ে যাওয়ায়। এই দৃশ্য একাধিকবার গতি কমিয়ে-বাড়িয়ে দেখানো। ঘটনার গভীর তাৎপর্য তুলে ধরতে। এই যুবতী চরিত্র শহুরে বেরোজগার যুবসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি।
ফর্ম বিলি করা বন্ধ হবে, ঘোষণার পর ঠেলাঠেলি-অস্থিরতা তুঙ্গে ওঠে। সেইসময় এক গ্রাম্য যুবক(সুপান্থ ভট্টাচার্য), তার সারাদিনের যাত্রার কথা বলতে থাকে। পর্দা দুভাগে ভাগ করা দেখা যায়। একদিকে তার মুখে ক্যামেরা স্থির, অপরদিকে তার সারাদিনের যাত্রার দ্রুত পট পরিবর্তন। স্প্লিট-স্ক্রিনের ব্যবহার, ও তার একদিক সচল রেখে অন্যদিক স্থির করার প্রয়োগ মৃণাল সেনের উদ্ভাবন। এই সচলতা দিয়ে দর্শক গ্রাম্য যুবকের আখ্যানে পৌছায়। জোতদার-চাষি-সরকারি অফিসারদের সম্বন্ধ ফুটে ওঠে। এই যুবকের বাবার মড়ক শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্রামের জোতদারের মুখ পর্দা জুড়ে ভেসে ওঠে। যা মড়ক ও জোতদারের সমীকরণ প্রকাশ করে। ডিজল্ড ও বিগ-ক্লোজআপ একই সঙ্গে হতে থাকে। বিশাল বোধ হয় জোতদার ছানা মন্ডলকে। পরের দৃশ্যে জোতদারের চলমান অবস্থায় বহু মানুষের গলা শোনা যায়। এই বহুকণ্ঠের অভিযোগ, প্রতীকী। মৃণাল সেন, এই চরিত্রের ভিতর দিয়ে জোতদার-জমিদার-মহাজনদের দুষ্কর্মের কথা বলতে চাইছেন। গ্রামীণ যুবক-তার অবস্থান-জোতদারের প্রভাব দেখানো এই কাহিনির মাধ্যমে।
আবার অপেক্ষারত জনতার ভিড়ে ফিরে আসে দর্শক। নানাজনের অভিব্যক্তি দেখা যায়। এক প্রৌঢ় ব্যক্তি(সত্য বন্দোপাধ্যায়), ধাক্কা-ঠেলা-গুঁতো সামলে দাঁড়িয়ে আছেন। একবার গর্জে ওঠেন। কিন্ত সাংবাদিক তার মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরলে থেমে যান। সাধারণ মানুষ যে মিডিয়ার সামনে সাধারণত সোয়াস্তি বোধ করে না, তার প্রতিচ্ছবি। সাংবাদিক অভয় দিলেও তার শট ‘ফ্রিজড’ হয়ে থাকে।এরপর কিছু কথা বলে দ্রত বেরিয়ে যান ভিড় ঠেলে।
গ্রাম থেকে শহরে আসা। কৃষকের দৈন্য থেকে শ্রমিকের লড়াই। শ্রমিকদের মিছিলকে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে গ্রামের মহিলাদের শঙ্খধ্বনি। চাষিরা সবাই না আসতে পারলেও, শসা-মুড়ি পাঠায় মিছিলের জন্য। আবার কোনো তথাকথিত, আধ-পাগলা মানুষ মিছিলে স্বেচ্ছায় যোগদান করে। শ্রমিকের মিছিল হয়ে ওঠে জনতার মিছিল। এর সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের কিছু খণ্ডচিত্রও তুলে ধরেন পরিচালক। যেখানে নেতারা আপোসের পথ বেছে নেয়। আন্দোলনের তুলনায়, ইউনিয়ন নিয়ে ভাগাভাগি গুরুত্ব পায়।
এই ছবির শেষে জনতার প্রভাব বোঝাতে 'মিরর ইমেজ' অর্থাৎ পর্দাকে দুভাগে ভাগ করে দুদিকেই একই দৃশ্য দেখানো হতে থাকে। তিরিশ হাজারের বিমূর্ত ধারণাকে মূর্তিমান করে তুলতে, পর্দায় গাদা-গাদা তিরিশ হাজার উঠছে ফুটে। তারপর সংখ্যাকে 'ক্রপ' করে, চারপাশ অন্ধকার(কালো) করে 'এম্ফেসাইজ' করেন পরিচালক।
এছাড়াও, চরিত্রদের নানান 'ম্যানারিজম' ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন, উৎপল দত্ত অভিনীত চরিত্র বিব্রত হয়ে উঠলে কেতাদুরস্ত ভাব ছেড়ে ‘ধ্যাত’ বলে ফেলেন। ছবির শুরুতে যাকে নির্দেশ দিতে দর্শক দেখেছে, ফোন আসায় সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। বুরোক্রেসিতে অভ্যস্ত মানুষ উচ্চপদাধিকারী সামনাসামনি না থাকলেও সম্মান জানাতে লেগে পড়ে। মৃণাল সেন পরিহাসের ছলে এই অভ্যাসকে কটাক্ষ করেন। শেষের দিকে, নিজেদের তৈরি কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর আটকে পড়ে মালিক হাঁস-ফাঁস করতে থাকেন। সন্ত্রস্তভাবে সিকিউরিটির খোঁজ করতে থাকেন। এটি একটি ফ্যান্টাসিক সিকোয়েন্সের মধ্যে দিয়ে দেখানো।
মৃণাল সেন সম্বন্ধে কথিত, তিনি নাকি রাজনৈতিক চিত্র নির্মাতা। সত্তর দশকের শুরুতে ওঁর বানানো, কলকাতা চিত্র-ত্রয়ী কে রাজনৈতিক বলা হয়ে থাকে। এরপরে বানান 'কোরাস'। তাতে রাজনৈতিক বক্তব্য যেমন বর্তমান, ছবি নিয়ে তেমন নানান আঙ্গিকগত পরীক্ষাও করেছেন। তার স্বল্প কিছু আলোচনা করা গেল। যার প্রধান আঙ্গিক, বিভিন্ন সিনেম্যাটিক পদ্ধতিতে ফ্যান্টাসি ও রিয়েলিটির প্রকাশ। ফ্যান্টাসির ভিতর দিয়ে ইচ্ছাপূরণের দিকে যাত্রা। জনমানসে সামাজিক বৈষম্যকে রুখে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরির আশায়।
Powered by Froala Editor