১৯৬১ সাল সেটা। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল। সামনের সারির আসন আলো করে বসে রয়েছেন এক বঙ্গসন্তান— সত্যজিৎ রায়। আর পর্দায় দেখানো হচ্ছে আরও এক বাঙালির ছবি। মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’। ছবি শেষ হওয়ার ঠিক পরেই সত্যজিতের দিকে এগিয়ে এলেন ফরসা, দোহারা চেহারার এক বিদেশী ভদ্রলোক। করমর্দন করার পরই তিনি আবদার করে বসলেন আলাপ করিয়ে দিতে হবে ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবির পরিচালকের সঙ্গে…
সেদিন সত্যজিতের কাছে যিনি এই আবদার করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, কিংবদন্তি ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক জিন মাসকোভিচ। তবে মৃণাল সেনের সঙ্গে সেদিন তাঁর দেখা করিয়ে দিতে পারেননি সত্যজিৎ রায়। কারণ, ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখানো হলেও, সেবার ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে অনুপস্থিত ছিলেন স্বয়ং পরিচালক। ব্যাপারটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন মাসকোভিচ নিজেও। শুধু অর্থাভাবের কারণে এত বড়ো মঞ্চ ছেড়ে দিতে হয় একজন এই মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতাকে?
জিনের এই অভিমানবার্তা সত্যজিতের দৌলতেই পৌঁছেছিল মৃণালের কাছে। দেশে ফিরেই মৃণাল সেনকে ফোনে সবটা জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ স্বয়ং। তবে আরও বড়ো চমক অপেক্ষা করেছিল তাঁর জন্য। মাস খানেক পরেই মৃণালের ‘বাইশে শ্রাবণ’ নিয়ে ফুল-স্কেপ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘দু সিনেমা’ পত্রিকায়। লেখক জিন মাসকোভিচ। চলচ্চিত্রটি নিয়ে লিখেছিলেন জর্জ মাদুল-ও।
বলতে গেলে, ‘বাইশে শ্রাবণ’ দিয়েই আন্তর্জাতিক জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল মৃণালের। মৃণালের প্রথম দুটি সিনেমা ‘রাতভোর’ এবং ‘নীল আকাশের নীচে’ সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি ভারতেই। আরও ভালো করে বলতে গেলে, দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারত সরকার। ‘পলিটিক্যালি ওভারটোনড’— এই কারণ দেখিয়েই চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ করেছিল প্রশাসন। এটিই ছিল স্বাধীন ভারতের প্রথম নিষিদ্ধ ছবি। কেন্দ্রের তথ্য ও প্রযুক্তিমন্ত্রকের চোখ এড়ায়নি ‘বাইশে শ্রাবণ’-ও। মৃণালের কাছে আদেশ এসেছিল বাদ দিতে হবে বেশ কয়েকটি দৃশ্য। তবে সেই আদেশ অমান্য করেই তড়িঘড়ি ভেনিসে এই ছবি পাঠিয়েছিলেন তিনি। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন
‘মায়াবন্দরের দিকে’ পাড়ি দিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী, ফুরলো শ্রুতি আন্দোলনের অধ্যায়
আরও পড়ুন
ঠাঁই হল না কলকাতায়, মৃণাল সেনের শেষ স্মৃতিচিহ্ন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে
’৬১-র ভেনিস উৎসবের বছর কয়েক পরের কথা। ’৬৯ সালে মৃণাল ফোন পেলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফরাসি চলচ্চিত্র সংগ্রাহক অঁরি লাঁগ্লোয়ার। আদেশ, ‘ভুবন সোম’ দেখাতে হবে ভেনিসে। তবে শুধু সিনেমা পাঠালেই হবে না, সশরীরে হাজিরাও দিতে হবে তাঁকে। অনুরোধ ফেলেননি মৃণাল। হাজির হয়েছিলেন। তবে এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছিল আরও এক বিপত্তি। বিমানযাত্রার সময় হারিয়ে গিয়েছিল ‘ভুবন সোম’-এর শেষ রিল। তাহলে উপায়? তীরে এসে তরি ডুববে তবে? সমাধান দিলেন লাঁগ্লোয়া স্বয়ং। জানালেন, সিনেমার শেষ অংশটা ফরাসি ভাষায় বলে দেওয়া হবে দর্শকদের।
আরও পড়ুন
প্রয়াত অধ্যাপক মৃণালকান্তি দোয়ারী, একাদশ শ্রেণীতে পদার্থবিদ্যা চিনিয়েছিলেন যিনি
এই চলচ্চিত্র উৎসবেই আরও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল মৃণালের। হঠাৎ করেই এক ব্যক্তি এসে অভিযোগ জানিয়েছিলেন, ‘বাইশে শ্রাবণ’ নিয়ে। খানিক রাগান্বিত হয়েই জানিয়েছিলেন, এ-হেন চলচ্চিত্রে সাবটাইটেল না রাখাটা বোকামিই। যদিও তাতে নাকি তাঁর ছবিটি বুঝতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ওঠার পর মৃণাল বুঝতে পেরেছিলেন এই ব্যক্তি আসলে জিন মাসকোভিচ। পরবর্তী দু’দশক মৃণালের বিদেশজয়ের অন্যতম সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ফরাসি এবং জার্মান চলচ্চিত্র জগতে মৃণাল একাধিকবার জুরির আসন ভাগ করে নিয়েছিলেন মাসকোচিভের সঙ্গে।
১৯৮৩ সাল। দিনটা ছিল ১৪ মে। ‘খারিজ’ নিয়ে কানে উপস্থিত স্বয়ং মৃণাল সেন। তাঁর উপস্থিতিতেই কানের মঞ্চে পালিত হল জন্মদিন। কাটা হল কেক-ও। অবশ্য, শুধু ৮৩-ই নয়, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত টানা ৬ বছরই জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর একটি করে চলচ্চিত্র দেখানো হয়েছিল কানে। এ-হেন সম্মান দ্বিতীয় কোনো বাঙালি বা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা পেয়েছেন কি? সন্দেহ আছে তা নিয়ে।
সত্তর, আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকেও বার্লিন, কান, ভেনিস, লন্ডন-সহ ইউরোপের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র উৎসবগুলির জুরির মঞ্চে রাজত্ব করেছেন মৃণাল। আসন ভাগ করেছেন তারকোভস্কি, ব্রেঁস, ইমামুরা, গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ, চ্যাপলিন-কন্যা জেরাল্ডিনের সঙ্গে। সেইসঙ্গে একাধিক চলচ্চিত্র সম্মাননা তো বটেই। বার্লিনে সিলভার বিয়ারও ঝুলিতে পুরেছেন মৃণাল। তবে ‘চলচ্চিত্র পরিচালক’-এর থেকেও ‘চলচ্চিত্র দার্শনিক’ হিসাবেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পরিমণ্ডলে। আসলে চলচ্চিত্রের কাহিনি এবং বিকল্প পথের অনুসন্ধানই সকলের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল মৃণালকে। আখ্যাননির্ভরতা কাটিয়ে চরিত্রদের ওপর বার বার জোর দিয়েছিলেন মৃণাল। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে উপস্থাপন করলেও, আলোকপাত করেছিলেন মূলত সাধারণ চরিত্রদের অনুভূতিগুলোর ওপর। অনন্যতা সেখানেই। ক্যামেরা লেন্সে মৃণালের এই দার্শনিকতাকে বন্দি করছে সুদূর জার্মানি থেকে কলকাতায় ছুটে এসেছিলেন জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক রাইনার্ড হফ। দীর্ঘ তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন মৃণালের রাজনৈতিক চলচ্চিত্র এবং ছকভাঙা সিনেমার দর্শন নিয়ে। অথচ তাঁর এই দূরদর্শিতাকে আদৌ কি সম্মান দিতে পেরেছে ভারতীয় চলচ্চিত্রমহল? প্রশ্ন থেকে যায় সেখানেই…
Powered by Froala Editor