গতকাল চলে গেল মৃণাল সেনের জন্মদিন। এমন আবহে অনেক ভালো কথাই ঘুরছে চারদিকে। সেই শর্ত মেনে চললে বলতে হয়, সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন কোনোদিন কোনো ঝামেলায় জড়াননি, মিলেমিশে কোলাকুলি করেই থাকতেন। শুনতে ভালো, তবে ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করা হবে। ১৯৬৫ সালে মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ ছবি নিয়ে দুজনের চূড়ান্ত ঝামেলা লাগে। সেই বিতর্কে সমকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ পরিষ্কার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। শোনা যায় বহুদিন কথা ছিল না দুজনের মধ্যে। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?
১৯৬৫ সালের ২৩ জুলাই ‘আকাশ কুসুম’ সিনেমার একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয় স্টেটসম্যানে। আকাশ কুসুম নামের কাহিনিটি নিম্নমধ্যবিত্ত পটভূমির এক তরুণকে নিয়ে। চটজলদি ধনী হতে চায় সে। কাহিনিতে কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন মৃণাল। এভাবেই ছবির নায়ক কেবল স্বপ্ন দিয়েই পুরো সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা টপকে যাওয়ার ধারণা নিয়ে অসম্ভব সব স্বপ্নের মরিয়া স্বাপ্নিকে পরিণত হয়। কিন্তু শেষ অবধি ব্যর্থ হয়ে শেষ সম্বলটুকুও খোয়ায়।
দ্য স্টেটসম্যানের সমালোচক আলোচনায় ছবিটি সারভেন্তেসের দোন কিহোতের আদলে হাস্যকর কিছু দিয়ে শেষ করলে, দর্শকরা হয়তো নায়কের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি বোধ করতেন বলে সিনেমাটিকে রোমান হলিডের বঙ্গীকরণ বলা হল। লাস্ট লাইনে লেখা হয় " It would be a pity if this film proved too adult, too anti sentimental for our matinee crowd". ব্যাস আর যায় কোথায়? ৩ আগস্ট-এর বিরুদ্ধে চিঠি লিখলেন ছবির সহকারী চিত্রনাট্যকার আশীষ বর্মণ। আশীষ বর্মণ জোর দিয়ে বলেন, এ ধরনের সমাপ্তি রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকত। কারণ ‘একটা সমসাময়িক বিষয়বস্তুতে রীতিমাফিক দ্ব্যর্থবোধকতা যোগ করা প্রায় অসম্ভব।’
তখনও ঠিক ছিল। আচমকা সত্যজিৎ রায় এই ঝামেলায় সেধে ঢুকে পড়লেন। মৃণাল সেন স্মৃতিচারণে বলেছেন, সত্যজিৎ রায় তাঁকে ফোন করে জানান, তিনি বর্মণের লেখার জবাব দিয়ে এ-বিতর্কে যোগ দিচ্ছেন। মৃণাল সেন যেন এ-ব্যাপারে মনে কষ্ট না পান। ‘আকাশ কুসুম’ ছবির চিত্রনাট্যকার-কাহিনিকার বর্মণই সত্যজিতের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হবে বলে মৃণাল সেনকে সত্যজিৎ আশ্বস্ত করলেও, তাঁর চিঠি প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, তিনি ছবির একেবারে ভিত্তিমূল অর্থাৎ সমসাময়িকতার ওপর সরাসরি আক্রমণ করেছেন। ফলে মৃণাল সেনের পক্ষে আর এ-পত্রযুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকা সম্ভব হল না। আশীষ বর্মণের চিত্রনাট্য ‘কাহিনীর সমসাময়িকতা, ভালোবাসা, ঈর্ষা, ক্ষুধা, আশা কিংবা ভালো জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষার মতো মৌলিক তাগিদকে নাকচ করে না’ উল্লেখ করে সত্যজিৎ রায়ের চিঠির সরাসরি জবাব দিয়ে একই সময়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিতর্কে শেষ পর্যন্ত যোগ দেন মৃণাল সেন। সমসাময়িকতার প্রশ্নে চ্যাপলিনকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন তিনি। অনেকেই মৃণাল সেনের পক্ষে চিঠি লেখা শুরু করেন, কেউ কেউ সত্যজিতের পক্ষে। সবাই রোজ পত্রিকা খুলেই দেখত আজ এই নিয়ে কে কী লিখলেন?
কিন্তু ‘আকাশ কুসুম’ ছবির সমসাময়িকতার প্রতি মৃণাল সেন ও আশীষ বর্মণের ক্রমাগত গুরুত্ব আরোপ, যুক্তি সত্যজিৎ রায়কে আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। এবার তিনি ছদ্ম রসিকতার সব আড়াল ছুড়ে ফেলে দিয়ে খোলাখুলি আক্রমণ চালালেন। ১৯৬৫-র ১ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে সত্যজিৎ যে ভাষায় আক্রমণ শানালেন, তা অভূতপূর্ব এবং প্রায় ব্যক্তিগত। লাইনে লাইনে মৃণালের ব্যবহার করা contemporary শব্দটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ, উপহাস... শেষ লাইনে সত্যজিৎ চরম ব্যঙ্গ করে আকাশ কুসুম-কে নিয়ে লেখেন : “A crow film, is a crow film is a crow film."
১৯৬৫ সালের ১৩ অক্টোবর দ্য স্টেটসম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে আকাশ কুসুম বিতর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করে উল্লেখ করে, এ বিষয়ে আর কোনো চিঠি ছাপা হবে না। ওইদিন সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা প্রদর্শনী ছিল। অডিটোরিয়ামে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন মুখোমুখি হন। সত্যজিৎ কিছুটা আমুদে সুরেই মৃণাল সেনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল, খুব দুঃখজনক! এভাবে বন্ধ করে দিলেন কেন? আরো বহু চিঠি লিখতে পারতাম আমি!’
‘বেশ, আমার তো আপনার মতো সমর্থক বা লোকবলের কোনোটাই নেই’— জবাব দিয়েছিলেন মৃণাল সেন। ‘আমি নেহাতই একা, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার সব চিঠিরই জবাব আমি দিতাম।
‘আকাশ কুসুম’ ছবির এ ঘটনা দিয়েই মোটের ওপর পরবর্তী সময়ে তাদের দুজনের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। হালকা চালের রসিকতার আড়ালে ওঁরা কার্যত পরিণত হন আগন্তুকে। সেই সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি...
ঋণ -
Film Polemics- Edited By Sakti Basu, Suvendu Dasgupta, CINE CLUB OF CALCUTTA, Page No. 33-51, সত্যজিৎ রায়ের ছবির বই, বইয়ের ছবি- রজত রায় (প্রবন্ধ), মৃণাল সেন- আমার ভুবন (২০০৪, দে'জ পাবলিশিং)।