খেলার মাঠেই হত্যা ব্রিটিশ জেলাশাসককে; ১৮ বছর বয়সে শহীদ মৃগেন্দ্রনাথ

সালটা ১৯৩৩। মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ড। যেদিকেই চোখ যায়, খালি লোক আর লোক! সবাই তৈরি হয়ে বসে আছেন গ্যালারিতে। মহামেডান বনাম টাউন ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ বলে কথা; উপরন্তু সাহেবরাও নাকি মাঠে নামবেন। এমন উত্তেজনার মুহূর্তেই ময়দানে হাজির হলেন মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জ। এরকম বড়ো ফুটবল খেলা হচ্ছে, আর তিনি থাকবেন না তা কখনও হয় নাকি! দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা যেন আরও বেড়ে গেল। কেউ খেয়াল করল না ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুণকে। তাঁদের দৃষ্টি সোজা মিস্টার বার্জের দিকে। চোখ স্থির, চোয়াল শক্ত। মেরুদণ্ড সোজা করে পকেট থেকে বের করল আগ্নেয়াস্ত্র। যে করেই হোক, আজ কার্যসিদ্ধি হওয়া চাই…

মেদিনীপুরের সবং থানার পাহাড়িপাড়ায় বেড়ে উঠছিলেন মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯১৫ সালে জন্ম; ঠিক দশ বছর আগে ঘটে গেছে বঙ্গভঙ্গ। বাংলা প্রতিটা কোণায় তখনও জ্বলছে আগুন। অনেক হয়েছে আর নয়। ব্রিটিশ রাজশক্তি এই দেশে এসে দেশের মানুষদের এভাবে অত্যাচার করবে আর সবাই চুপ করে মেনে নেবে, তা হতে পারে না। ধীরে ধীরে শুরু হল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। এমন পরিস্থিতিতেই জন্ম মৃগেন্দ্রের। আর মেদিনীপুর তখন সমস্ত আন্দোলনের কেন্দ্রে। কাজেই অচিরে সেই ছোঁয়া তাঁর গায়েও এসে লাগল। 

ঠিক কেমন ছিল মেদিনীপুর? এমনিতেই মাত্র কয়েক বছর আগে ব্রিটিশরা ক্ষুদিরাম বসুকে চিনেছে। তারপর থেকে এই মাটিই একের পর এক লড়াইয়ের জন্ম দিয়েছে। পেডি এবং ডগলাস নামের মেদিনীপুরের দুজন জেলাশাসককে হত্যা করেন বিপ্লবীরা। তারপর আর কোনো ব্রিটিশ সাহেবই এই জেলার প্রধানের দায়িত্বে আসতে রাজি ছিলেন না। প্রশাসন মহা সমস্যায় পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন বার্জ সাহেব। যথেষ্ট সাহসী ও ধুরন্ধর এই ব্যক্তি মেদিনীপুরের জেলাশাসক হিসেবে আসেন। আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা তো ছিলই; সেইসঙ্গে নিজেও অনেক সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সবসময় সঙ্গে থাকত আগ্নেয়াস্ত্র। তার ওপর কোনো রুটিন জীবনযাপন রাখতেনই না। কার্যালয় যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকত না, প্রতি মুহূর্তে রাস্তাও বদলে যেত। যাতে কোনোভাবেই তাঁর গতিবিধির সঙ্গে একাত্ম হতে না পারেন বিপ্লবীরা— এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। 

এই সময়ই মেদিনীপুর টাউন স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। সেখানেই পরিচয় আরেকজনের সঙ্গে— অনাথবন্ধু পাঁজা। দুজনেই তখন বেঙ্গল ভলান্টিয়ারসের সঙ্গে যুক্ত। এখানেই স্বদেশপ্রেমের স্বাদ আরও বেশি করে পান মৃগেন্দ্র। ক্রমশ শপথ নেন পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের। আঠেরো বছরের এক তরতাজা তরুণ তিনি। অনাথবন্ধু কিছুটা বড়ো। এরই মধ্যে চলছে পিস্তল চালানো শেখা। কলকাতায় গিয়ে গোপনে সেই বিদ্যা শিখেও এলেন তাঁরা। ঠিক হল, জেলাশাসক বার্জকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। মরতে তাঁকে হবেই! সেই দায়িত্ব দেওয়া হল অনাথবন্ধু এবং মৃগেন্দ্রনাথকে। 

আরও পড়ুন
অপরাধীদের তালিকায় শহীদ ক্ষুদিরাম বসু! হিন্দি ওয়েব সিরিজে অবমাননা বাঙালি বিপ্লবীকে?


কিন্তু কেমন করে? প্রচণ্ড কড়া পাহারায় থাকেন তিনি। নিজেও সদা সতর্ক। এতটুকুও ফাঁদে পা দিতে চান না। এই জায়গায় নামা মানে ঝুঁকির কাজ। তাও রাজি হলেন দুই তরুণ। মেদিনীপুরে জন্ম তাঁদের, এত সহজে দমে যাবেন নাকি! ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসে একবার চেষ্টা করা হল। ব্যর্থ প্রচেষ্টা। অভাবনীয়ভাবে এসে গেল দ্বিতীয় সুযোগ, কয়েকমাস পরেই। মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ডে ফুটবল ম্যাচ। আর বার্জ নিজে বিশাল ফুটবল ভক্ত। কাজেই এই খেলা দেখতে তিনি আসবেনই! মাঠের একদিকে জেলখানা, অন্যদিকে অস্ত্রাগার। পুলিশের পাহারা চারিদিকে। জীবনের ঝুঁকি; তাও চেষ্টা করতে হবে… 

আরও পড়ুন
দেশলাই কাঠিতে ‘অমর শহীদ স্মৃতিসৌধ’, গিনেস রেকর্ডে হ্যাটট্রিকের পথে নদীয়ার যুবক

খেলা শুরু হওয়ার আগের মুহূর্তে মাঠে নেমে পড়লেন ফুটবলাররা। তার মধ্যেই মাঠে এসে ঢুকল জেলাশাসক বার্জের গাড়ি। পুলিশ ঘিরে রেখেছে তাঁকে। কিন্তু ফুটবল যে তাঁকে দেখতেই হবে। কে জানত, এটাই তাঁর নিয়তি হয়ে ধরা দেবে! মাঠের পাশে ভিড় থেকে হঠাৎ গর্জে উঠল রিভলভার। সবাই চমকে গেল। চমকালেন না কেবল বার্জ সাহেব। মোক্ষম নিশানায় গুলি সোজা গিয়ে বিঁধেছে তাঁর বুকে। রক্তাক্ত শরীরে গাড়ির ভেতরেই লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ছুটে এলেন এক ইংরেজ ফুটবলার, জোন্স। এবার আরেকটি রিভলভার গর্জে উঠল। জোন্স লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে, পায়ে লেগেছে গুলি। পুলিশরা হতভম্ব! কে করল এমন কাজ? জনতা এদিকে ওদিকে দৌড়তে লাগল। 

তারই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এল দুজন তরুণ। হাতে চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র। বার্জের নিথর শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অনাথবন্ধু পাঁজা। একের পর এক গুলি বিঁধিয়ে দিল ওই শরীরে। পালিয়ে যেতেই পারতেন; যাননি। পুলিশের দলও উল্টোদিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। দুজনেরই শরীরে এসে লাগল বুলেট। মৃগেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন অনাথবন্ধু পাঁজা। আর মৃগেন্দ্র? এক রাতের লড়াই শুধু। ঘটনার পরেরদিন হাসপাতালেই মারা যান তিনি। মেদিনীপুর আরও এক শহিদ তরুণের রক্ত পেল। স্বাধীনতার দিকে আরও একটু অগ্রসর হল দেশ। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More