‘না, না, আমি কখনো ফিল্ম স্কুলে পড়িনি। আসলে আমি সরাসরি ফিল্মে ঢুকে পড়েছিলাম।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানান তরুণ পরিচালক। তাঁর স্বভাব হল প্রচুর কথা বলা, খানিক ব্লা ব্লা করা আর বেশ নাটুকে ধরণে উপস্থাপন। - ফিল্ম আপনার কাছে কী? - হাসতে হাসতে তরুণ উত্তর দেন, ‘ওঃ, বুঝলেন কিনা, ফিল্ম হচ্ছে দুটো লোক, একটা বন্দুক, ট্রিগারে চাপ আর দুম করে গুলির শব্দ... অমনি চারদিকে রক্ত!’
এত কেন রক্তের ছড়াছড়ি ছবিতে... এই নিয়ে যখন ভদ্রলোককে বিবিসি-র তরফে জিজ্ঞেস করা হয়, বেশ খেপে গিয়েই তিনি বলেন, ‘মশাই, আমি আপনার চাকর নই! আপনি আমাকে বাঁদর পাননি যে নিজের গানের সুরে নাচাবেন। আমি দেব না জবাব!’
বিতর্ক কখনোই পিছু ছাড়েনি। প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান ছবি-করিয়ে মাইকেল হানেকে আপত্তির সুরে বলেন, ‘কী বলব, ‘পাল্প ফিকশন’ আমি থিয়েটারে গিয়ে দেখেছিলাম। একটা দৃশ্য ছিল না, সেই যে বাম্পারে গাড়ি ঝাঁকুনি খেল, ভিনসেণ্টের হাত থেকে গুলি গিয়ে লাগল কালো যুবকের মাথায়... গাড়ি ভর্তি খুলির টুকরো আর রক্ত... সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! তাই দেখে গোটা হল জুড়ে কী হাসি কী হাসি, আমার পাশের ছেলেটা দমই আটকায় যেন!’ ... অনেকেই নাক কুঁচকে বলেন, ‘অঃ, টারান্টিনো! ও তো রক্তারক্তি নিয়ে মজা করে। ছাড়ুন ওর কথা।’
কুইন্টিন টারান্টিনো কিন্তু গোঁ ধরেই থেকেছেন। মজা আর রক্ত বাদ দিয়ে তিনি ছবি করেন নি। তাঁকে কেউ কেউ ঠাউরেছেন শয়তান, কেউ কেউ ভেবেছেন দায়িত্বজ্ঞানহীন আহাম্মক। পৃথিবী জুড়ে অনেক ফিল্ম-কীটের কাছে আবার টারান্টিনো মানেই তুখোড় সিনেমাটিক বোধ, তছনছ ক’রে গল্প-বলা আর সিনেমার প্রতি রক্তাক্ত প্রেম! এত বেশি অতীত-ছবি থেকে তিনি বেমালুম দৃশ্য, চরিত্র, সংলাপ তুলে নিজের ছবিতে যত্রতত্র বসিয়ে দিয়েছেন, একে ‘প্রেম’ না বললে অন্যায়। কিন্তু এ কি রেফারেন্স, না হোমাজ? টারান্টিনো স্রেফ নস্যাৎ করে বলেছেন, ‘ধুর মশাই, আমি আজ অবধি তৈরি হওয়া সমস্ত ছবি থেকে চুরি করেছি। ভালো শিল্পীরা চুরি করে, খারাপেরা নেহাতই নকলনবিশ।’ দেখা যাবে যে, এই বাক্যটিও তিনি পাবলো পিকাসো থেকে মানে মানে ঝেড়ে দিয়েছেন!
আরও পড়ুন
বিশ শতকের সবচেয়ে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তিত্ব বলা হয়েছিল তাঁকে
‘নাহ, আমি বায়োপিক পছন্দ করি না। এসব হচ্ছে অস্কার পাওয়ার অজুহাতে বানানো ছবি। যদি আমাকে বলা হয় বায়োপিক তুলতে, ধরা যাক এলভিস প্রেসলিকে নিয়ে একটা ছবি, তাহলে আমি এলভিসকে ছোটো থেকে বড় অবধি দেখাতে চাইব না। বরং, ওর জীবনের একটা দিন বেছে সেটা নিয়ে গোটা ফিচার বানাব,’ জানিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
মৃত্যুদণ্ড ও রাষ্ট্রকে নিশানা করেছিল সস্তায়-বানানো কিছু সিনেমা
প্রথম ফিচার ছবি ‘রেজারভয়ার ডগস’ (১৯৯২) থেকেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র সার্কিটে খ্যাতি, সম্মান, পুরষ্কার। শুরু হয় কয়েক ঘন্টার গল্পকে নন-লিনিয়ার ধাঁচে বলে পরম উপভোগ্য ক’রে তোলা। অতীত বা বর্তমান, সময়কে দুমড়ে মুচড়ে ‘সিনেমা-সম্মত’ ক’রে দেখানো, লুটেরাদের চোস্ত কথ্যবুলি, অজস্র ইয়াংকি রসিকতা, কড়া রকমের খুনোখুনি আর মাধ্যমটির ওপর তুঙ্গ দখল! বোঝাই যায়, এলভিস প্রেসলির ওপর বায়োপিকটি তিনি তুললে কেমন হতে পারত।
আরও পড়ুন
শঙ্কু থেকে কিশোর গল্প, বারবার সেই অজানা দেশ ‘ডুংলুং ডো’ খুঁজেছেন সত্যজিৎ
‘পাল্প ফিকশন’ (১৯৯৪), যার মানে হল ‘সস্তা বই’। টারান্টিনো সস্তা ধরণের সিনেমা দেখে বড় হয়েছেন, খুনোখুনি আর স্থূল আবেগের যত ভিডিও ক্যাসেট সব তাঁর মুখস্থ, তাই তিনিও তেমন ছবিই বানাবেন – সহজ কথা! ... রূপবতী ব্লণ্ড কন্যা, মোষের মতো গ্যাংস্টার, ধার্মিক খুনে আর প্রেমিক স্মাগলার – মার্কামারা সব চরিত্র নিয়ে তিনি তুলে গেলেন দু ঘন্টা ব্যাপী রগরগে ছবি। মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে দর্শক হেসে অস্থির হল, পরিচালকের আশ্চর্য দক্ষতায় তাজ্জব বনে গেল, বিচ্ছিন্ন গল্পের জিগ-স’ পাজল এক করতে গিয়ে হিমশিম খেল। সমস্ত সংলাপ সমেত রাতারাতি ‘কাল্ট’ হয়ে গেল ‘সস্তা ছবি’টি!
আরও পড়ুন
আউশভিৎচ নিয়ে স্পিলবার্গের ছবিকে খারিজ করেছিলেন মাইকেল হানেকে
টারান্টিনোর ছবি-কোম্পানির নাম ‘বন্দ এ পার’, জঁ লুক গোদারের ১৯৬৪ সালের ছবি-নাম থেকে তুলে নেওয়া, এই সাদাকালো ফরাসি ছবিটির প্রতি নিজের দুর্বলতা পরিচালক নির্লজ্জ মুখেই কবুল করেন। ছবিতেও তেমনি ছড়িয়ে থাকে মজাদার সব উদ্ধৃতি। স্যামুয়েল জ্যাকসন অভিনীত ধার্মিক খুনি ‘জুল’ আর স্বয়ং টারান্টিনো অভিনীত ‘জিম’, খুনে আর খুনের বন্ধু জুল আর জিম মনে পড়িয়ে দেয় আরেকটি সাদাকালো ছবির কথা। এটিও ফরাসি দেশের ছবি, ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো-র বিশ্বখ্যাত ‘জুল এ জিম’ (১৯৬২)।
টারান্টিনোর ছবি হচ্ছে সিনেমার ইতিহাসের প্রতি আবেগের, ভালোবাসার ছবি। তাঁর ছবিতে দেখানো রক্তপাত বাস্তবের রক্তপাত নিয়ে নয়, বরং অতীত-সিনেমায় রক্তপাতের ইমেজ নিয়ে নিজস্ব ঠাট্টা, মন্তব্য, অনুরাগ। টারান্টিনো বাস্তবধৃত রাজনীতি নিয়ে ছবি করেন না, তিনি সিনেমা-ইতিহাসের রাজনীতি নিয়ে মজে থাকেন। ... সিনেমার রক্তাক্ত জয় ঘোষণা করতে তাঁকে বানাতেই হয় দুই ভলিউমের ‘কিল বিল’ (২০০৩), নাৎসিনিধনের বি-কল্প কাহিনি নিয়ে ‘ইংগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’ (২০০৯)।
প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন সত্তর দশকের এক্সপ্লয়টেশন ছবির নায়িকা পাম গ্রিয়ের, তাঁকে সম্মান জানিয়ে কাস্ট করেন ‘জ্যাকি ব্রাউন’ (১৯৯৭) ফিল্মের নামভূমিকায়। ছবির গল্প থ্রিলার-লেখক এলমোর লেওনার্ডের ‘রাম পাঞ্চ’ উপন্যাস থেকে নেওয়া। লেখক পরে জানান, তাঁর গল্প থেকে যত ছবি হয়েছে, এটাই হচ্ছে সেরা।
সের্জেই লিওনি-র ‘দি গুড, দি ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি’ প্রশ্নাতীত ভাবে কুইন্টিন টারান্টিনোর প্রিয়তম ছবি, যেটি ছিল এক ক্লাসিক স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন। এই জঁরের প্রতি নিজের প্রণয় জানাতে তৈরি হয় ‘জ্যাংগো আনচেইন্ড’ (২০১২) আর ‘হেটফুল এইট’ (২০১৫)। প্রচুর বিতর্ক, খ্যাতি, প্রশংসা। ... সংলাপে বারবার এত ‘নিগার’ কেন! কৃষ্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার স্পাইক লি এই নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। টারান্টিনো নির্বিকার ভাবে মন্তব্য করেন, ‘জাতি বিদ্বেষ না কচু! স্পাইক লি-টা আবার কে? আমার নিতম্বে চুমু খেতে হলে ওকে আগে চেয়ারে উঠে দাঁড়াতে হবে।’
এ-হেন পরিচালক নিজের যে ছবিটিকে নিয়ে বেশ লজ্জায় পড়ে যান, তার নাম ‘ডেথ প্রুফ’। ২০০৭ সালে বানানো গ্রিন্ড-হাউজ স্ল্যাশার ছবি নিয়ে তাঁর সাফাই, ‘না না, আসলে ব্লান্ডার হয়ে গেছিল। এটায় বেশ বাজে রকম ছড়িয়েছি।’
ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রতি ভয়ানক বিরাগ, পঁয়ত্রিশ মিলিমিটার সেলুলয়েড উঠে গেলে আর ছবি করবেন না, জানিয়েছেন টারান্টিনো। গত বছর কমেডি ছবি ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন হলিউড’ রিলিজ করেছে, যেটি ছিল তাঁর নবম ছবি। আর মাত্র একটা ছবি করা বাকি। ‘দশটার বেশি ছবি করব না, কারণ দেখেছি ভালো পরিচালকেরা বুড়ো বয়সে ভীষণ ছড়ান। দশটা করেই রিটায়ার করব’, ২০১৬ সালে ঘোষণা করেন। এখনও সিদ্ধান্তে অনড়।
এই বছর ২৭ শে মার্চ এই বেয়াড়া তরুণের সাতান্ন বছর বয়স হল।
Powered by Froala Editor