বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (তৃতীয় পর্ব)

দি উইন্ড উইল ক্যারি আস
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরান, ১৯৯৯    

সাংবাদিক দাড়ি কামাচ্ছে - অর্থাৎ আরো একটি দিন কেটেছে, আমরা রাত্রি দেখতে পাইনি।
ছবিটি ইচ্ছে করেই রাত্রিকে দেখাচ্ছে না, আমরা বুঝতে পারি। শুধু দিনের একটি বিশেষ সময়কেই ধরছে।

সাংবাদিকের মুখ আমরা দেখছি আয়নার প্রেক্ষিতে, যেন আয়নাই দেখছে সাংবাদিকের মুখ।
তারপরের শটে আমরা দেখছি আয়নাটি, আবারও বাস্তবতার পাশ-বদলের প্রয়োগ।
আয়নারও চোখ আছে, এমন একটি কৌতুক ক’রে আব্বাস আমাদের উশকে দিচ্ছেন চিন্তা করতে।

আমরা দেখছি উল্টোদিকের বারান্দায় এই নারীকে। ইনি গর্ভবতী। এই বাড়িতে একটি মৃত্যু ঘটতে চলেছে এবং একটি প্রাণ আসতে চলেছে।
একটি বাস্তবতার অবসান, একটি বাস্তবতার সূচনা।
চেতনা তথা বাস্তবতার উৎপত্তিস্থল কি এই মহিলার গর্ভ?
নাকি তার উৎস আছে ব্যাপক প্রকৃতিতে, ব্রহ্মাণ্ডের কোনো অজানা কোণে?
নাকি তার উৎস সেই বাস্তবতার ‘ওপার’-এই?

আবার ফ্রেম উইদিন ফ্রেম- আমরা দেখছি।
সাংবাদিকের গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে এই মাত্র চলে গেছে। এখন ভেড়া ও গরু চলেছে।
দূরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
চিত্রকর্ম হিসেবে অনন্য।

আমরা দেখি, গর্তের মানুষকে দুধ দিতে আসা গ্রাম্য মেয়েটি ছুটে পালাচ্ছে।
সাংবাদিক গাড়ি থেকে নেমে তাকে দেখছে।
এই মেয়েটিকে আমরা পেছন থেকে দেখব, কিন্তু সামনে থেকে দেখতে পাব না একবারও। ছবিতে আবার অপূর্ব এক সিকোয়ন্সে মেয়েটি ফিরে আসবে।
সিনেমার চোখে সাধারণ মেয়েটি রহস্যময়ী এক নারী, শাশ্বত পৌরাণিক চরিত্র হয়ে উঠবে।

সাংবাদিক ফোনে কর্তৃপক্ষের কাছে তার উদবেগ প্রকাশ করছে। উদ্বেগ, কেননা বৃদ্ধা এক দিন ভালো থাকছেন, অন্যদিন অবনতি হচ্ছে। ফলে নিশ্চিত করে মৃত্যুর দিন সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না।
সাংবাদিকের অপেক্ষা মৃত্যুর জন্যে।
পৃথিবী কিন্তু নিজের নিয়মে, নিস্তরঙ্গ, নিরুত্তাপভাবে চলছে। প্রকৃতির ঝলমলে রোদ্দুর আর সাংবাদিকের উদ্বেগ বিরোধাভাস তৈরি করছে।
প্রতি মুহূর্তে আমাদের আব্বাস সচেতন করছেন, যে, আমাদের চেনা বাস্তব থেকে এক জন বিদায় নিতে চলেছে।
ফলে বাস্তবতার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে সিনেমার কাছে।

সাংবাদিক গর্তের সামনে বসে আছে-  ফ্রেমের সীমাবদ্ধ, সেলফ-সেন্সর্ড প্রয়োগ। গর্ত দেখানো হচ্ছে না।
গর্তের মানুষ স্বীকার করছে, ঐ মেয়েটি তার প্রেমিকা। সে জানাচ্ছে, প্রেম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না।
অত্যন্ত গ্রাম্য, সাদামাটা কথা শুনে সাংবাদিক মুচকি হাসছে।
আমাদের কাছে, সিনেমার দর্শকের কাছে এই কথার অর্থ দাঁড়াচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তা দৈববাণীর মতো লাগছে, লাগছে পবিত্র আত্মার মুখ নিঃসৃত বাক্যের মতো।
যেহেতু তা 'ওপার' থেকে আসছে।

বন্ধুদের সাথে কথা বলছে সাংবাদিক। গাড়ির বাইরে বন্ধুরা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
এবারেও আব্বাস বন্ধুদের দ্যাখার অনুমতি দিচ্ছেন না, ফ্রেমটুকুতে কেবল সাংবাদিককে ধরছেন।

বন্ধুদের গলা পাচ্ছি। তারা চলে যাওয়ার সময় পিঠের আভাসটুকু পাচ্ছি। মুখ দেখছি না।
আমাদের ছমছমানি বেড়ে যাচ্ছে, এই মানুষগুলি বাস্তবে থেকেও কেমন অ-বাস্তব হয়ে যাচ্ছে, প্রেতায়িত হয়ে যাচ্ছে।
গোটা গ্রামের অনেক মানুষই এভাবে বেঁচে থেকেও ভূতের মতো হয়ে উঠছে ছবিটার কাছে।
ছবির ভাষা ছবির চরিত্রদের অর্থ / দ্যোতনা পালটে দিচ্ছে এভাবেই।

সেই মহিলাকে আবার আমরা দেখছি, এবারে উনি গর্ভবতী নন আর, কারণ শিশুটি পৃথিবীতে চলে এসেছে।
তিনিও কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
একটি নতুন চেতনা ও সংশ্লিষ্ট বাস্তবতা (একটি নতুন ব্রহ্মাণ্ড) জন্মে গেছে।
সাংবাদিক অপেক্ষা করছে একটি অন্য ব্রহ্মাণ্ডের অবসানের জন্যে।

সাংবাদিক ফোনে কথা বলছে, সে কর্তৃপক্ষকে জানায়, তাদের অপেক্ষা করতেই হবে, অন্য কোনো উপায় নেই।
কেননা বৃদ্ধাকে তো স্বাভাবিক ভাবেই মরতে দিতে হবে, অপঘাত হলে হবে না। বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টি দেখতে হলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে- কখন মৃত্যু এসে নিজের নিয়মে বৃদ্ধাকে নিয়ে চলে যায়।
সাংবাদিক অতএব অপেক্ষা করছে মৃত্যুর আগমনের জন্য।
মৃত্যু যেন এক সত্তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এখানে এসে।

সাংবাদিক ফারজাদের কাকাকে লিফট দেয়, আব্বাসের সিগনেচার- তিনি বাস্তবের একটি পাশই দেখাতে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। সাংবাদিকের মুখ, দুজনের সংলাপ।

এবারে কাউন্টার শটে কাকার মুখ। দুজনের সংলাপ।
অর্থাৎ পরিপ্রেক্ষিতের বদল বোঝাতে শটেরও বদল। বাস্তবের একটি পাশই কেবল দেখানো, টু শটের বদলে।

ফারজাদের কাকা গাড়ি থেকে নামলে আমরা দেখি, তার পা খোঁড়া।
এতক্ষণ তা আমরা বুঝতে পারিনি, কারণ বাস্তবের একটি টুকরোই আমরা ফ্রেমবন্দি অবস্থায় দেখছিলাম।
আমরা কখনোই পুরো বাস্তবকে দেখে এবং বুঝে উঠতে পারি না, আব্বাস বলেন।
আমাদের বাস্তব আদতে বাস্তবতার কিছু টুকরোর সমন্বয়।

ফারজাদের স্কুলে ধর্ম বিষয়ের পরীক্ষা।
ফারজাদ একটি প্রশ্ন পারছে না, প্রশ্নটি প্রবল ভাবেই মৃত্যুচেতনাময়।
বিচারের দিনে পাপী ও পুণ্যবানের কী হবে?
পাপী নরকে যাবে, পুণ্যবান স্বর্গে।
আবার আব্বাস আমাদের ওপারের ধারণাকে উশকে দিচ্ছেন। ওপার কি একটাই? ধর্ম বলছে, না, তা দুটি ভাগে বিভক্ত- স্বর্গ ও নরক।

ফারজাদের কাছ থেকে সাংবাদিক বৃদ্ধার বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছে।
বৃদ্ধার অবস্থা কেমন, এটাই তার মাথাব্যথা এখন।
ফারজাদ কথা বলছে গ্রাম্য বিশ্বাস ও সারল্য থেকে, সাংবাদিক কথা বলছে নাগরিক ব্যস্ততা ও উদবিগ্নতা থেকে। গ্রাম নিজেকে সরল ভাবে প্রকাশ করছে, শহর নিজেকে কৌশলে লুকিয়ে রেখেছে।
উভয় স্থানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটি আব্বাস দেখাচ্ছেন।

সাংবাদিক দুধ খুঁজতে বেরিয়েছে। আসলে সে যেতে চায় ঐ গর্তের মানুষটির প্রেমিকার কাছে। তার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে সাংবাদিকের।
মেয়েটির খোঁজ করছে সে দুধ খোঁজার অছিলায়।

সাংবাদিক দুধ আনতে ঢুকছে গোয়ালঘরে - এটি সেই 'প্রেমিকা'র বাড়ির গোয়ালঘর।

সাংবাদিক গোয়াল ঘরে ঢুকে এগোচ্ছে ক্যামেরার দিকে- আমাদের দিকে।
তার অবয়ব (সিল্যুয়েট) বড়ো হচ্ছে।
বড়ো হতে হতে তা ক্যামেরাকে কভার করে দেয়।
অন্ধকার হয়ে যায় পর্দা।
অন্ধকার থেকে শব্দ আসছে।
গোরুর ডাকের শব্দ।
আমরা যেন আসন্ন মৃত্যুকে অনুভব করছি!
শব্দটুকুই যেন জীবনের প্রমাণ।
সাংবাদিকের অবয়ব ক্যামেরা কভার করে দিলে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসার সেন্সেশন হয়।
তারপর অন্ধকার থেকে যায় এক মিনিট ধরে স্ক্রিনে।

অন্ধকার কেটে যায় একটি মেয়ের আগমনে। তার হাতে ধরা লণ্ঠন।
এ সেই ‘প্রেমিকা’।
মেয়েটি ঢুকে আসে হাতে আলো নিয়ে- আমাদের যেন স্বর্গে আসার মতো অনুভূতি হয়।
যেন বেহেস্তের কোনো হুর-পরী ঢুকছেন।
মেয়েটির মুখ কাপড়ে ঢাকা। সে তার মুখ দেখায় না।

(ক্রমশ)