দি উইন্ড উইল ক্যারি আস
আব্বাস কিয়ারোস্তামি
ইরান, ১৯৯৯
সাংবাদিক উপস্থিত বুড়ো ডাক্তারকে নিয়ে চলে বৃদ্ধার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। আমরা আশ্বস্ত হই, কেননা কুয়োর লোকটি বেঁচে যাবে, তাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বুড়ো ডাক্তার বাইকের পেছনে সাংবাদিককে বসিয়ে নিয়ে চলেন।
ডাক্তারকে আমরা কাছ থেকে দেখতে পাই না, দূর থেকে, মিড নয়তো লং শটে দেখি।
হাওয়া দিচ্ছে জোরে, বাইক যাওয়ার পথ গিয়েছে ঘাসের বন চিরে।
অপূর্ব নিসর্গের মধ্যে তারা কথোপকথন করতে থাকে।
কথাবার্তা একদম কাছ থেকে শোনা যায়, যখন বাইক আমাদের থেকে অনেক দূরে।
মনে হয় যেন প্রকৃতি থেকেই কথা উঠে আসছে।
জিগজ্যাগ পথ, ঘাসের বন। বাইক চলেছে, তাকে বিন্দুর মতো লাগছে। দুই আরোহী অতি ক্ষুদ্র এই ল্যান্ডস্কেপের কাছে।
কিন্তু তারাই ফ্রেমের কেন্দ্রে, তাদের সংলাপই সাউন্ডস্কেপের কেন্দ্রে।
অতি সাধারণ, পথচলতি কথা , কিন্তু এটি আমাদের কাছে হয়ে যায় একটি দার্শনিক আলাপ।
সাংবাদিক সিগারেট খেতে অনুমতি চাইলে ডাক্তার তাকে বলেঃ তোমারই ক্ষতি হবে। সাংবাদিক পরিহাস করে বলেঃ এই বিরাট প্রকৃতি, এই হাওয়া বাতাসকে দূষণ করতে আমার সিগারেট পারবে না।
ডাক্তার তখন উত্তর দেয়ঃ এই ব্যাপকতাকে দূষিত করতে তোমার সিগারেট পর্যাপ্ত নয়।
এখানে ফ্রেমে ধরা দেয় বিরাটতা। ছবিতে খণ্ড ফ্রেমে বন্দি দৃশ্যের সীমাবদ্ধতা থেকে ক্যামেরা বেরিয়ে এসে ধরতে থাকে ব্যাপক, বিরাট প্রকৃতিকে।
এতক্ষণ খন্ডের মধ্যে বাস্তবতাকে পাচ্ছিলাম আমরা, এবার যেন সমগ্রের আভাস পেতে থাকি।
এবং বুঝতে পারি, এই বিরাট ল্যান্ডস্কেপও আদতে অতি ক্ষুদ্র এক বাস্তবতা। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড, যা অন্তহীন বলে আমরা জানি, তার সাপেক্ষে এই 'বিরাটতা'র কীই বা মানে আছে?
এবং , আমরা যাকে জানি না, সেই মৃত্যুর ওপারে যে জগত, যা না থাকলেও আছে তার থাকার সম্ভাবনা - তা কি আরো ব্যাপক? তা তো আমাদের জানারই বাইরে!
বৃদ্ধার বাড়িতে এসে ডাক্তার চিনতে পারে।
পৌরাণিক বৃদ্ধ চরিত্র মেথুসেলার সঙ্গে বৃদ্ধার তুলনা করে সে।
ডাক্তার ঢুকে যায় ঘরে, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টির সীমার ওপারে।
সাংবাদিক নিজের ঘরে এসে সদ্যোজাত শিশুটিকে দোলা দেয়, মা যেহেতু অনুপস্থিত তার।
আবার তারা ফিরছে- ডাক্তার ও সাংবাদিক, ঐ একই ঘাসের বনের পথে।
ডাক্তারের সঙ্গে বৃদ্ধার স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হচ্ছে।
ডাক্তার বলেঃ মৃত্যু সবচেয়ে খারাপ রোগ।
কারণ, কেই বা আছে যে মৃত্যুর ওপার থেকে ফিরে এসে বলবে, জায়গাটা কেমন? ওমর খৈয়ামের কবিতা সে আবৃত্তি করে।
বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপ, হাওয়ার গর্জন, দৃশ্যের কেন্দ্রে একটি বাইকে দুজন এবং সাউন্ডস্কেপের কেন্দ্রে খৈয়ামের কবিতা- আমাদের মনে হয় যেন আবহমান ফারসি সভ্যতা কথা বলে উঠছে।
বাইকটি যখন আমাদের দৃষ্টির আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে, তখনও সাউন্ডস্কেপের কেন্দ্রে জোরে শোনা যাচ্ছে ডাক্তারের বৃদ্ধ গলাঃ বর্তমানকে, ইহজীবনকে ভালোবাসো!
ঘাসের দোলা যেন এই কথার সমর্থনে, হাওয়ার গর্জন যেন দৈববাণীর প্রতিবেশ!
ছবিতে এই প্রথম আমরা রাত্রি দেখতে পাই। শেষরাতের গ্রাম, এক্ষুণি আলো ফুটবে।
রাত্রি - এই প্রথম কেন? এই রাতেই বৃদ্ধা মারা গেছেন, আমরা এখুনি জানতে পারব।
আমাদের আন্দাজ, দিন ও রাত বিপরীত ও যুগ্ম শব্দ, তেমনই জীবন ও মৃত্যু।
এতক্ষণ আব্বাস সমগ্র দিনের একটি অর্ধ দেখিয়ে গেলেন, যেভাবে উনি জীবন-মৃত্যময় সমগ্রতার মধ্যে শুধু জীবনকেই দেখেছেন। এবার মৃত্যু এসেছে, সে নিজের নিয়মে বৃদ্ধার জীবন নিয়ে চলে গেছে। সেই দ্যোতনা বোঝাতে বাস্তবের অপর অংশ- দিনের অপর অংশ- রাত্রিকে আব্বাস দেখলেন, দেখালেন।
রাত কেটে কিন্তু ভোর হয়ে গেল অতি দ্রুত। আলো ফুটল।
তবে কি রাতই মৃত্যুসময়? একে বেশিক্ষণ দেখার অধিকার আমাদের নেই?
রাতে আমরা ঘুমোই, অন্য বাস্তবে চলে যাই।
রাত- বাস্তবতার ওপারের সোপান?
রাত- এজন্যেই ক্ষণস্থায়ী হল আব্বাসের ছবিতে?
জানলার ওপারে আলো জ্বলছে, মৃত্যু এসে নিয়ে গেছে বৃদ্ধার জীবন।
আমরা দেখছি একজন মহিলার ছায়া, ঘরে কান্না কাটি চলছে।
সাংবাদিক দেখছে।
সাংবাদিক গাড়িতে উঠেই দেখতে পায়, বৃদ্ধার অন্ত্যেষ্টির জন্যে গ্রামের মেয়েরা আসছেন, তাদের রিচুয়াল পালন করতে।
সে ছবি তুলতে থাকে খুশিমনে, তার ওপর এখন আর গ্রাম্য নিষেধ প্রযুক্ত হয় না।
কালো ও নীল পোশাক- গ্রামের মহিলারা পরে আছেন। মৃত্যুর রং।
সাংবাদিকের গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পরে একজন বৃদ্ধ ফ্রেমে ঢোকেন। বৃদ্ধার ছেলে। এনারও দিন ঘনিয়ে আসছে।
ইনি কোন দিকে হেঁটে যাচ্ছেন? মৃত্যুর দিকে? ওপারের দিকে?
ক্যামেরার এদিকটা কি ওপার?
সাংবাদিকের গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা হাড়টি আমরা দেখছি।
এটি ন্যারেটিভ থেকে দলছুট হয়ে গেছিল, আবার এটি ন্যারেটিভের অংশ হয়ে যাবে।
সাংবাদিকের গাড়ির কাচের এপার থেকে আমরা ওপারকে দেখছি।
জল দিয়ে কাচ মোছা হচ্ছে।
ঝাপসা ওপার। একট নদী চলে গেছে।
সাংবাদিক নদীর জলে হাড়টি ফেলে দেয়।
হাড়টি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে, নদীর জল যে দিকে যায় সেইদিকে। জলের স্রোতই নির্ধারণ করছে তার গতি।
এটি এক মানুষের দেহের অংশ ছিল, আজ সেই মানুষটি নেই, এই ঘনীভূত স্মৃতিচিহ্নটুকু আছে।
প্রাণহীন হাড়টিকে সম্ভ্রমের সঙ্গে ক্যামেরা দেখছে, আমরা দেখছি, এটিতে প্রাণ নেই, এটি জল বা মাটির মতোই বস্তুপৃথিবীর অংশ হয়ে গেছে।
একটি বিষণ্ণ, গম্ভীর আবহ এই প্রথম ছবিতে বেজে ওঠে।
জলের ধারে কয়েকটি ছাগল ঘাস খাচ্ছে, তারা জানেই না হাড়টির অস্তিত্ব সম্পর্কে। তারা নিশ্চিন্তে খেয়ে যাচ্ছে ঘাস।
আমরাও কি এদের মতোই মৃত্যুকে না জেনে, মৃত্যু সম্পর্কে অসচেতন থেকেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি না?
জীবন প্রবাহিত হচ্ছে, জীবন যেমন প্রবাহিত হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগেও।
অগণন মৃত্যু এই পৃথিবী দেখেছে।
মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাই?
এই নিসর্গের মধ্যে, বাস্তবের আলোছায়ার মধ্যে অগণন মৃতেরা যেন আমাদের ইঙ্গিত করছে, কিছু বলতে চাইছে।
ছবির অন্তিম ইমেজঃ হাড়টিকে দেখতে দেখতে ক্যামেরা একটু উঠে যায়- সে এবার জলের গতিময়তা দেখতে থাকে।
জলে সূর্যোদয়ের লাল আভা পড়েছে।
ব্রহ্মাণ্ডের একটি নক্ষত্র আলো দিচ্ছে পৃথিবী নামক একটি গ্রহে। পৃথিবীতে প্রতিফলিত মহাজাগতিক ইমেজ - জলে প্রতিফলিত সূর্যালোক।
জলের ওপারে কী আছে?
আকাশের ওপারে কী আছে, যেমন আমরা জানি না, জলের ওপারে কী আছে তাও কি জানতে পারি?
আকাশের ওপারে আকাশ, বাতাসের ওপারে বাতাস।
জলের ওপারে তেমনই শুধু- জল আর জল।
জলের এই উপরিতল যেমন ভাবে সমস্ত নিচু তলগুলি ঢেকে রাখে, আড়াল করে রাখে, এই জীবন, এই বাস্তবতাও তার সংখ্যাহীন স্তরে স্তরে ঢেকে রাখে অপর বাস্তবকে।
জীবন, ঢেকে রাখে মৃত্যুকে।
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে- ফারুখ ফারুখজাদের প্রেমের কবিতা। - রোমান্টিক উচ্চারণ।
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে- আমাদের ভস্ম, আমাদের শরীরের ধুলো। - আধ্যাত্মিক উচ্চারণ।
আমাদের কাছে এইই সার্বভৌম সত্য, জানার জন্যে শেষতম বস্তু, জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা।
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে।
(সমাপ্ত)