শিল্পী ও তারকার দ্বন্দ্বে বাঙ্ময় সৌমিত্র-'অভিযান'

১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার’ ছবিটিকেও যদি অভিযানের শুরু বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও সেই অভিযান দীর্ঘ ছয় দশকের। আর তার আগেও কলেজ জীবন, রাজনীতি, আকাশবাণীর ভাষ্যকারের চাকরি – পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অভিযান’ (Abhijan) সিনেমাটিতে উঠে এসেছে সেইসব দিনের প্রসঙ্গও। ফলে এই দীর্ঘ জীবনকে একটি সিনেমার পরিসরে বন্দি করার কাজটা সহজ নয়। পরিচালক সেটা কতদূর করে তুলতে পেরেছেন, দর্শকের দিক থেকে এই প্রশ্ন ওঠাও অসঙ্গত নয়। অন্তত যখন প্রায় সকলেই ধরে নিয়েছিলেন, এই সিনেমা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chattopadhyay) বায়োপিক, অথবা তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি একটি পূর্ণদৈর্ঘের তথ্যচিত্র। ছবিটি দেখার আগে এই আগে থেকে তৈরি করে রাখা ধারণাটা ভাঙতেই তাই একটু সময় লেগে যায়।

প্রকৃতপক্ষে ‘অভিযান’ কোনো বায়োপিক নয়, তথ্যচিত্র তো নয়ই। সিনেমাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ফিচার সিনেমা। যার কেন্দ্রে রয়েছেন একজন ‘তখনও জীবিত’ কিংবদন্তি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জীবন রয়েছে। রয়েছে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য ঘটনাও। তবু এই সিনেমা ইতিহাসের দলিল নয়। ইতিহাসের দলিল হয়ে ওঠার কোনো চেষ্টাও নেই এর মধ্যে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এই ধরনের চেষ্টা একেবারেই নতুন। তাই একটা সময়ে এসে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের চিত্রায়ণ তার গতি পেয়ে যায়, সেখানে এসেই আবার নতুন করে বদলে যায় সবকিছু। এই সিনেমার কেন্দ্রে কি শুধুই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? নাকি খোদ পরিচালক পরমব্রত অভিনীত চরিত্র প্রবাসী বাঙালি অঙ্কোলজিস্ট সঞ্জয় সেন? নাকি আসলে সেই সমস্ত মানুষ, যাঁরা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে একে একে উঠে আসতে আসতে নিজেদের মূল থেকে সরে এসেছেন। এরপর আর চাইলেও ফিরে যেতে পারবেন না সেই দিনগুলোতে। সিনেমার কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বই হয়ে ওঠে তাই সৌমিত্রের সেই অনুভূতির দোটানা। সঞ্জয় সেনের কথায় ‘ডবল স্ট্যান্ডার্ড’। যে সৌমিত্র অকপটে ঘোষণা করেন, তিনি প্রথম থেকেই একজন স্টার। এই স্টারডমকে তিনি এনজয় করেন, অথচ অ্যাডমিট করেন না।

উত্তম বনাম সৌমিত্র নয়, ‘অভিযান’-এ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন সৌমিত্র বনাম সৌমিত্রই। আর সেই দ্বন্দ্বের অভিঘাতটিও তৈরি হয়েছে নাটকীয়ভাবেই। বাঙালির ‘শেষ ইন্ট্যালেকচুয়াল আইকন’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি মনে করতেন যাঁরা বই পড়েন না তাঁদের সৌমিত্রের জীবন জানার কোনো প্রয়োজন নেই, জীবনের শেষ রাতে এসে তাঁরও মনে হয় অনেক কথা বলা বাকি থেকে গিয়েছে। তাঁর নাতি রণদীপ তখন এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালে ভর্তি। হয়তো নাতির মধ্যেই তাঁর উত্তরাধিকারটা বেঁচে থাকবে, ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু এই দুর্ঘটনাটাই হঠাৎ একটা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে। তাই বহুবার তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার পরেও এবারে রাজি হয়ে যান তিনি।

প্রসঙ্গত, এই দুর্ঘটনার বিষয়টিকে মুখ্য করে তোলার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আপত্তির কথা জানিয়েছেন সৌমিত্রকন্যা পৌলমী বসু এবং তাঁর পরিজনদের একাংশ। তবে বাস্তব এবং কল্পনাকে মিলিয়ে ফেলার ঘটনায় যে আশঙ্কার কথা পৌলমী বসু জানিয়েছেন, সেখানে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে সাহিত্যের আঙিনায় এমন কাজ আগেও হয়েছে। নন-ফিকশন গোত্রের কাহিনি সত্যের অপলাপ ঘটায় বলে অনেকেই মনে করেন। তবুও বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যেও নন-ফিকশন যথেষ্ট সমাদৃত। যদিও রণদীপের চিকিৎসার খরচ বহন করার জন্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণে রাজি হয়েছেন বলা হলে তাতে অবশ্যই আপত্তির জায়গা থাকে। একটি প্রথম সারির বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে হয়তো তেমন বার্তাই পৌঁছেছে। তবে সিনেমায় বিষয়টি আদৌ সেভাবে বলা হয়নি। ঠিক যেমন প্রৌঢ় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর কোন প্রিয় বান্ধবী ফোন করেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকে। তেমনই অনেকে শিল্পীর রোজগারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন এই নির্দিষ্ট ঘটনাটিকেও। কিংবদন্তির ঘরের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ার এই চেষ্টা বাঙালি হিসাবে সত্যিই আশঙ্কার। লজ্জারও।

আরও পড়ুন
এবার আরবের মাটিতেও ফেলুদা, সৌদি চলচ্চিত্র উৎসবে 'জয় বাবা ফেলুনাথ'

সিনেমার নির্মাণেও বেশ কিছু বিষয় নজর কাড়ার মতো। স্মৃতিরও নিজস্ব প্রকৌশল আছে, দৃশ্যায়নে সে-কথা মনে রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। তাই পুরনো দিনের কথা যখন দেখানো হয়েছে, তখন কখনও দৃশ্যের গতি বেড়েছে, কখনও মন্থর হয়েছে। এই দৃশ্যগুলিতে আলোকসম্পাতও বেশ ভালো। বিশেষ করে ‘ঝিন্দের বন্দি’-তে উত্তমকুমারের মুখোমুখি দাঁড়ানো থেকে ক্রমশ একজন তারকার হয়ে ওঠাকে ধরতে যে স্ট্যাটিক মন্তাজের ব্যবহার করা হয়েছে, ধীর গতির সেই মন্তাজও নজর কাড়ার মতো। যদিও সেখানে প্রথমে ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘যদি জানতেম’ এবং তারপর একে একে ‘আকাশ কুসুম’, ‘চারুলতা’ এবং ‘তিনকন্যা’ ছবির নাম কেন দেখানো হল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষত ‘তিনকন্যা’ ছবিটি যখন ‘ঝিন্দের বন্দি’-র আগেই মুক্তি পেয়েছে। ছবিটি জুড়ে এমনই বিভিন্ন তথ্যগত ত্রুটি বেশ চোখে লাগে। যেমন কলেজ পড়ুয়া সৌমিত্র যখন কফি হাউসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন, তখন সেখানে কোনোভাবেই খাদ্য আন্দোলনের পোস্টার থাকতে পারে না। আবার অভিনেত্রী সংঘের বিভাজনের সময় হল মালিকরা যে শিল্পীদের ছবি বয়কট করবেন বলে লিফলেট প্রকাশ করেছেন, সেখানেও অনিল চট্টোপাধ্যায়ের নাম চোখে লাগে। কারণ অনিল চট্টোপাধ্যায় যে সেই সময় ধর্মঘটের বিপক্ষে ছিলেন, সে-কথা সৌমিত্র নিজেই লিখে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
শুধু ‘মন্দার’-ই নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে একাধিকবার ছায়া ফেলেছে ম্যাকবেথ

অল্প বয়সের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় যিশু সেনগুপ্তকে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে গিয়েছে। তবে সিনেমার দৃশ্যে তাঁর কণ্ঠস্বর মোটামুটি মানিয়ে গেলেও বাচিকশিল্পী এবং ভাষ্যকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উচ্চারণের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কাছে আকাশবাণীর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় যিশু সেনগুপ্তের কণ্ঠ একটু হতাশাজনক মনে হবে। আবার সৌমিত্রের পাশাপাশি ফিরিয়ে আনতে হয়েছে রবি ঘোষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, বিকাশ রায়, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, ওয়াহিদা রহমান, তনুজা, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন এবং অবশ্যই শিশির ভাদুরী, সত্যজিৎ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়দের। এতজন কিংবদন্তি চরিত্রকে একটিমাত্র সিনেমায় ফিরিয়ে আনতে গেলে চরিত্রায়নে জটিলতা তৈরি হবেই। কোনোরকম প্রস্থেটিক ব্যবহার না করেই সাজসজ্জায় চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তোলার কাজটা সত্যিই কঠিন ছিল। তার পরেও সব মিলিয়ে কাজটি মসৃণই হয়েছে। বিশেষ করে সুচিত্রা সেনের চরিত্রে পাওলি দামকে বেশ মানিয়েছে। অন্যদিকে অভিনয় জীবনের একেবারে চূড়ান্ত সময়ে থাকা উত্তমকুমারের ভূমিকায় বৃদ্ধ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে একটু দৃষ্টিকটুই লেগেছে। তাছাড়া তাঁর চরিত্রটিকেও একটু বেশিই আহাম্মক দেখানো হয়েছে। উত্তমকুমার যে শুধু পর্দাতেই তারকা ছিলেন না, বরং ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সেই তারকোচিত আভিজাত্য নিয়েই চলতেন, এ-কথা সৌমিত্রই তো বারবার বলে গিয়েছেন। সেই উত্তমকুমার প্রকাশ্যে নিজের পড়াশোনার গভীরতার অভাবকে জাহির করবেন, এমনটা একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে।

আরও পড়ুন
বাংলার 'প্রথম' চলচ্চিত্র সমালোচক তিনি, চিদানন্দ দাশগুপ্তকে কতটা মনে রেখেছে বাঙালি?

স্বর্ণযুগের একের পর এক কিংবদন্তি সিনেমার দৃশ্যকে নতুন করে নির্মাণ করার ক্ষেত্রেও বেশ সাহসিকতা দেখিয়েছেন পরিচালক। প্রতিটা শট নিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। এমনকি ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় কাজলের কাছে অপুর ফিরে আসার সেই বিখ্যাত দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বদলে যিশু সেনগুপ্তকে হেঁটে যেতে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবে যত বেশি সময় ধরে এক-একটি সিনেমার দৃশ্য রাখা হয়েছে, তা একটু বাহুল্যই যেন-বা। আসলে এমন একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে গেলে বারবার পরীক্ষানিরীক্ষা করে নেওয়ার প্রয়োজন থেকেই যায়। সেখানে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন ব্যস্ত অভিনেতার পক্ষে সবটুকু সময় দেওয়া যে সত্যিই কঠিন, তা স্বীকার করতেই হবে। অন্যদিকে সিনেমার শুটিং চলাকালীনই বিদায় নিলেন খোদ সৌমিত্রবাবু। ফলে তখন আর নতুন করে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ঘটানোর জায়গাও ছিল না। এতরকম প্রতিকূলতার মধ্যেও সিনেমাটি যে মুখ থুবড়ে পড়েনি একেবারে, এটাই সার্থকতা।

আর সিনেমাটির মূল সুর তৈরি করে দিয়েছে রাজনীতি সচেতন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তারকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বৈরথই। এই দ্বন্দ্বকে যথেষ্ট সফলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন পরমব্রত। প্যারিসের মঞ্চে লিজিওঁ ডি অনর সম্মান নিতে ওঠার পায়ে পায়ে শেষ হয় সেই অভিযান। চিত্রনাট্য এখানেই শেষ হয়ে যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর দৃশ্যে পৌঁছানোর আর কোনো সুযোগও ছিল না। তবু শেষ মুহূর্তে রবি ঠাকুরের ‘তোমার অসীমে’ গানে জীবন আর মৃত্যুর দুই সীমান্তকেই ছুঁয়ে যেতে হয়। থমকে যেতে হয় এই ভেবে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। অথচ একজন শিল্পীর জীবনের দ্বন্দ্বের নিরসন তো কোনোদিন হয় না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও হয়নি। এই দ্বন্দ্বই একজন শিল্পীকে গড়ে তোলে, বাঁচিয়ে রাখে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More