“আমরা যখন বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনই হঠাৎ এসে এলাকার ঘাস কাটা শুরু হয়। কিন্তু ঘাস আর আগাছা কেটে ফেললেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। এই অঞ্চলের ইতিহাসকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, আরও গবেষণা চালাতে হবে। উপর উপর সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। তাই আমরা এখনও আন্দোলনের কথাই ভাবছি।” বলছিলেন ‘পাণ্ডুরাজা প্রত্নগবেষণা কেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রাধামাধব মণ্ডল। পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রামের বুকে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র পাণ্ডুরাজার ঢিবি। যার বয়স প্রায় সিন্ধু সভ্যতার কাছাকাছি। অথচ ১৯৬০-এর দশকে এই প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কারের পরেও এতদিন ধরে গবেষণার কাজ প্রায় কিছুই এগোয়নি। এবং ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন রাধামাধববাবু।
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের রসফাল্লা পুকুরপারের এই জমিটি স্থানীয়ভাবে রাজাপোতা নামে পরিচিত। আর এর পাশেই আছে পাণ্ডুক গ্রাম। ১৯৬২ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক পরেশনাথ দাশগুপ্ত প্রথম এই অঞ্চলে খননকার্য শুরু করেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪ বার খননকার্য চলে। কিন্তু এরপর নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে খননকার্য আর চালানো যায়নি। ১৯৮৫ সালে আর একবার খননকার্য চালানো হয়। কিন্তু এর পর থেকেই আর কোনো গুরুত্ব পায়নি এলাকাটি। এমনকি এই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে কোনো প্রচারও হয়নি। রাধামাধববাবু জানালেন, “৫ দফার খননকার্যে মোট ৪৫০০টির বেশি প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ১৪টি প্রস্তরলিপি এবং ১১টি নরকঙ্কাল। প্রতিটি কঙ্কালের উচ্চতা ১১ ফুটের কাছাকাছি। অর্থাৎ এদের অস্ট্রিক নিনাদ গোষ্ঠীর মানুষ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও ভারতে প্রথম কলসসমাধি পাওয়া গিয়েছে এখানেই।” এই প্রতিটা সামগ্রী আজ রাজ্যের বিভিন্ন মিউজিয়াম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে বলে অভিযোগ তুলেছেন রাধামাধববাবু। তাই তাঁদের দাবি, এলাকার মধ্যেই একটি সংগ্রহশালা তৈরি করে প্রতিটা নমুনা পর্যটকদের দেখার এবং গবেষকদের গবেষণা করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বয়সের দিক থেকে মোট ৪টি দফায় ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার হদিশ পাওয়া গিয়েছে এই অঞ্চলে। সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাটি প্রায় ৩৫০০ বছরের পুরনো। এরপরের পর্যায়ের বিকাশ ঘটেছিল মোটামুটি ৩২০০ বছর আগে। তৃতীয়টি প্রায় ২৮০০ বছর আগের। এবং শেষ পর্যায়ের বিকাশ ঘটেছিল আনুমানিক ১০-১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তবে প্রতিটা সভ্যতার মধ্যে যে একটা নিরবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র রয়েছে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। আর প্রায় ৩ হাজার বছর আগেই এই অঞ্চলের মানুষ ধাতুর গয়না, হাড়ের তৈরি অলঙ্কার এবং হাতির দাঁতের সামগ্রীও ব্যবহার করত। ফলে এই অঞ্চলের সভ্যতা বেশ উন্নত ছিল বলে মনে করা যায়। সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেও এই সভ্যতার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন রাধামাধববাবু।
রাধামাধববাবু এবং তাঁর সংগঠনের দাবি, অবিলম্বে জায়গাটির যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থাকে। পাশাপাশি তিনি জানালেন, “পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ দাশগুপ্ত, ডঃ দেবকুমার চক্রবর্তী, শ্যামচাঁদ মুখার্জী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ওয়াই ডি শর্মা, হংসলাল ধীরাজলাল শঙ্খলিয়া, ডঃ বি বি লাল প্রমুখ যে খননকার্য চালিয়েছিলেন, তার রিপোর্টও প্রকাশ্যে আনতে হবে।” এছাড়াও এলাকায় উপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, একটি বাতিস্তম্ভের মতো পরকাঠামোগত উন্নয়নের দাবিও তুলেছেন তাঁরা। আসলে এই এলাকার ইতিহাসকে জানতে পারলে গোটা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণাটাই বদলে যাবে বলে আশাবাদী তাঁরা। আর তাই ইতিমধ্যে সমস্ত সরকারি দপ্তরে দাবিপত্র পাঠিয়েছেন তাঁরা। তাতে উত্তর না পাওয়া গেলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের ইঙ্গিতও দিলেন রাধামাধব মণ্ডল।
আরও পড়ুন
ঠুড়গা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পে ধ্বংস হবে প্রস্তরযুগের প্রত্নক্ষেত্রও, সরব পরিবেশকর্মীরা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মেক্সিকোর প্রত্নক্ষেত্রে অবৈধ নির্মাণ, সরব জাতিপুঞ্জ