‘ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম’ – পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদে সমন্বয়ের বার্তা রামবন্দনায়

‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম/ সব কো সম্মতি দে ভগবান’— পার্ক সার্কাস ময়দান তখন লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ ভেসে এল এই গান। চারপাশে জটলায় ফিসফাস, কথা চালাচালি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর একে একে সবাই গলা মেলাতে শুরু করলেন এই গানে। সাম্প্রতিকে যে রাম একটি বিশেষ মতাদর্শের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল, যে রামকে ঘিরেই বিভেদ বা বিভাজনের রাজনীতি হচ্ছে বলে সরব হয়েছিলেন অনেকে, সেই রঘুপতি রাঘব রামের ভজনই হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। যে প্রতিবাদ জমায়েতে এই গানটি গাওয়া হয়েছে, সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ। সম্প্রতি পার্ক সার্কাস ময়দানে এনআরসি-সিএএ বিরোধী সমাবেশ চলছে। রাত জাগছেন অসংখ্য মানুষ। এ-আন্দোলনের সামনের সারিতে মহিলারা। এই প্রতিবাদ জমায়েতেই হাজির হয়েছিলেন মৌসুমী ভৌমিক, সাত্যকি ব্যানার্জি, শ্রেয়সী দস্তিদার, শুভব্রত সেনরা। গাইতে উঠে, তাঁদের কণ্ঠে ধরা দিল এই গান। আলোড়ন সৃষ্টি করল, এবং তারই পাশাপাশি জন্ম দিল একটি নতুন তর্কেরও।

বিতর্কের হদিশটি মিলেছে মূলত ফেসবুকে। সেখানে বলা হয়েছে, পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদী জমায়েতে গিয়ে রামের ভজন গাওয়াটা পরোক্ষে হিন্দুত্বকেই উস্কে দিল কিনা। এর উত্তর দিয়েছেন মৌসুমী ভৌমিক নিজে। তিনি বলেছেন। রাম বললেই কি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কথা মাথায় আসে? এই গানটি কি আসলে হিন্দুত্বের জয়গান?

‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ ভজনটির ইতিহাস শুধুই ভক্তিতে লীন নয়। একটা সময় এই গানই হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা, ঐক্যের ভাষা। এখন যে সুরটি আমরা শুনি, সেটা তৈরি করেছিলেন বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এই সুরকেই ব্যবহার করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তখন চলছে আইন অমান্য আন্দোলন। ঐতিহাসিক ডান্ডি অভিযানের সময় গোটা রাস্তা গান্ধীজি এবং তাঁর সঙ্গীদের মুখে ছিল এই ভজনটি। তখন আর সেটি নিছক ভজন নয়, হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মন্ত্র। ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম’-এর কথায় যেন সমস্ত ভেদাভেদ মুছে দিয়ে একটা ভারতবর্ষের ছবি দেখিয়েছিলেন গান্ধীজি।

এই কথাটিকেই নিজের কথায় তুলে ধরেছেন মৌসুমী ভৌমিক। রাম বললেই কি শুধু একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কথা মাথায় আসে? এখনকার রাজনীতিতে সেইরকমই ধারণা তৈরি হলেও, আসল ইতিহাস তো সেটা বলে না। বরং ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ আইন অমান্য আন্দোলনের ইতিহাসকেও দর্শায়। আইন অমান্য আন্দোলন তো আজও চলছে; শাহিনবাগে, পার্ক সার্কাসে, দিল্লিতে, লখনউতে… দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে সেই আগুন। মৌসুমী বলছেন, সারা দেশজুড়ে যখন বিভেদের রাজনীতি চলছে, তখন তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এটিকে সমন্বয়ের গান হিসেবেই হাজির করেছিলেন তাঁরা।

বিতর্কও উঠে এসেছে এখানে। যে রামকে নিয়ে এত হুঙ্কার তোলা হয়, তাঁকেই কি করে আপন করে নেন এই শিল্পীরা, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই বিতর্কগুলো খুব সঙ্গত, মানছেন মৌসুমীও। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন - “একটা গানকে আসলে একইভাবে সবাই দেখবেন তেমন আশা করার মানে হয় না। এবং একটা গানের যখন কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকে, তখন সেই ইতিহাসকেও আমরা নানা ভাবে পাঠ করব, সেটাই স্বাভাবিক… এ কিন্তু কোনও ব্রাহ্মণ্যবাদী রামায়ণ নয়, এ কোনও fringe-এর রামায়ণও নয়। অসংখ্য মানুষ এই গান শোনেন আসরে। মুসলমানও শোনেন। ওঁরা পালার ভিতরে নানা গান বুনে দেন”।

বিতর্ক চলছে। মৌসুমী ভৌমিকের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন অনেক মানুষ। সেদিনের প্রতিবাদী জমায়েতে উপস্থিত মানুষরাও এই গান শুনে আন্দোলিত হয়েছেন। এই কথা উল্লেখ করে অনেকে বলছেন, গানটিকে সদর্থকভাবেই গ্রহণ করেছেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষরাও। যুক্তি আসছে, আন্দোলন-প্রতিবাদ একেকটি গানকে নতুন-নতুন করে আবিষ্কার করে। ফলে এই গানের ভিতরে যদি হিন্দুত্বের সংগুপ্ত বয়ান থাকেও, তাহলেও এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গানটির নবজন্ম হল। কিন্তু উল্টো কথাটিও উঠছে। এভাবে আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমন্বয়ের নামে হিন্দু বয়ানকেই সামনে এনে ফেলা হল আরেকবার। এটি আসলে ‘হিন্দুত্বে লীন নিরপেক্ষতা’।

বিতর্কের উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু পার্ক সার্কাসের এই প্রতিবাদ মঞ্চ যেমন সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তেমনই সেই প্রতিবাদ মঞ্চের সমন্বয়ের বার্তা দিতে রামের ভজন উঠে আসছে – এও যে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনাই, তাতে সন্দেহ নেই। এই বিতর্ক, আন্দোলন, ভাষ্য কোনদিকে মোড় নেয়, তা অবশ্য ইতিহাসই বলবে।