মতি নন্দী, কলাবতীর ক্রিকেট ও একটি সত্যি-গ্রামের গল্প

মতি নন্দীকে নিশ্চই মনে আছে আপনাদের? লেখক, ঔপন্যাসিক মতি নন্দী? বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় যাঁরা কমবেশী বিচরণ করে থাকেন তাঁরা তো বটেই, আবার যাঁরা খেলাধুলাও ভালোবাসেন তাঁদের কাছে মতি নন্দীর লেখা একটা অন্য মাত্রা বয়ে আনে। 

মতি নন্দী ছিলেন বাংলা ভাষার সেই বিরল প্রজাতির লেখক যিনি সাহিত্যের সঙ্গে স্পোর্টসকে অনায়াস দক্ষতায় মিলিয়েছেন। বস্তুত বাংলাভাষায় খেলাধুলোকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক ভাবে গল্প উপন্যাস, বিশেষতঃ শিশু এবং কিশোরদের জন্য, প্রথম তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে এবং এই ধারায় তাঁকে পথিকৃৎও বলা চলে।

তবে আজ আমি লিখতে বসেছি কলাবতীকে নিয়ে। মতি নন্দী একটি অসাধারণ কিশোর চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, সেই কলাবতী। কলাবতী সিরিজের মোট আটটি উপন্যাস আছে। অনেকেই পড়েছেন হয়তো, যাঁরা পড়েননি তাঁদের জন্য কলাবতী চরিত্রটির একটি ছোট্ট মুখবন্ধ দিই।

কলাবতী হল কলাবতী সিংহ। ডাক নাম কালু, ছোটদের প্রিয় কালুদিদি। সে পড়ে কাঁকুড়গাছি উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস ইলেভেনে। মেয়ে খুব ডাকাবুকো, ইংরেজীতে যাকে বলে Tomboyish। ক্রিকেট খেলায় চৌকস, মেয়েদের ক্রিকেটে বেঙ্গল টিমে খেলেছে। বনেদি জমিদার পরিবারের মেয়ে, ছোটোবেলাতেই মাকে হারিয়েছে। বাবা দিব্যশেখর স্ত্রীবিয়োগের পর সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করেছেন। মা মরা কলাবতীকে তার দুবছর বয়সে তার মাসী নিয়ে যান পুনেতে। দশ বছর বয়সে কলাবতী ফিরে আসে কলকাতায় দাদু রাজশেখর সিংহ এবং কাকা ব্যারিস্টার সত্যশেখর সিংহর কাছে।

এহেন নাতনির ক্রিকেট খেলা নিয়ে দাদু রাজশেখরের প্রবল উৎসাহ। সিংহ পরিবারে ক্রিকেট খেলার চল বহুদিন থেকে। ঊর্ধ্বতন দুই পুরুষ বলেন্দ্রশেখর আর সৌমেন্দ্রশেখর দুজনাই ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন এবং রাজশেখরও যৌবনে ক্রিকেট খেলেছেন। তাঁর দুই সন্তানের কেউই ক্রিকেট খেলায় আসেনি বলে তাঁর আক্ষেপ আছে, তাই নাতনিকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা। মেয়ে হলেও পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মকে ক্রিকেটার হিসেবে তৈরী করতে তিনি কার্পণ্য করেননি।

আরও পড়ুন
যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও

আমি কলাবতী সিরিজের প্রথম উপন্যাস পড়ি পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলাতে। সময়টা তখন কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণ। ওই বয়সে মন কল্পনাপ্রবণ হয়, আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। গল্পের চরিত্রের প্রেমে পড়া যায় কিনা জানি না, কিন্তু ওই কাঁচা বয়সে কলাবতী চরিত্রটা আমায় ভীষণ টেনেছিল। হয়তো ওই Tomboyish ব্যাপারটাই আমাকে আকর্ষণ করার কারণ। আমার চেনাপরিচিতির গণ্ডিতে এই চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় এমন কেউ ছিল না, অতএব চরিত্রটি আমার কাছে এক অন্য রকম ভালোলাগা বয়ে এনেছিল। নেহাতই কিশোর উপন্যাস বলে লেখক কোনো প্রেমের অ্যাঙ্গেল রাখেননি, অন্তত কলাবতী চরিত্রটির জন্য, কিন্তু সেই বয়সে আমি মনে মনে কল্পনা করেছিলাম এর মধ্যে একটা মিষ্টি প্রেমের উপাখ্যান থাকলে হয়তপ মন্দ হত না।

আবার ফিরে আসি উপন্যাসে। গল্পর মুল প্রতিপাদ্য হল বংশগত মানমর্যাদাকে কেন্দ্র করে  দুই জমিদারবাড়ির আকচাআকচি যেটার প্রতিফলন ঘটে দুই জমিদারির মধ্যে হওয়া একটি বার্ষিক ক্রিকেট ম্যাচে। এটি লেখকের জবানিতেই একবার দেখে নেওয়া যাক।

"হুগলী জেলায় আটঘরা আর বকদিঘী নামে পাশাপাশি দুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। দুই গ্রামের দুই জমিদার বংশ সিংহ ও মুখুজ্জ্যেদের মধ্যে আকচাআকচি প্রবল। সামান্য বা অসামান্য সব ব্যাপারেই উভয়ের মধ্যে রেষারেষি।  জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর সেটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে দুই গ্রামের মধ্যে বছরে একবার একটি ক্রিকেট ম্যাচকে উপলক্ষ করে। মহা ধূমধামে দুর্গোৎসবের মতো এই বাৎসরিক ম্যাচ হয়। এক মাস আগে থেকেই দুই গ্রামের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-পুরুষ টেনশনে ভুগতে শুরু করে। প্রতিবার এই খেলায় একটা-না-একটা ঝঞ্ঝাট বাধেই, আর তাই নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়।"

আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও

দুই পরিবারের এই ইজ্জতের ম্যাচে ক্রিকেট প্লেয়ার হিসেবে স্বভাবতই কলাবতী খেলতে চায়। দাদু রাজশেখরেও তাই ইচ্ছে, পরিবারের সদস্য হিসেবেই কলাবতী খেলুক। কিন্তু বাদ সাধে বকদিঘির ক্যাপ্টেন পতু মুখুজ্যে। সে সাফ জানিয়ে দেয় কোনো মেয়েকে এই ম্যাচে তারা খেলতে দেবে না।

সেই ম্যাচে কীভাবে স্থানীয় এম এল এর ছেলে ব্রজদুলাল ওরফে দুলুকে যার আটঘরার টিমে খেলার কথা ছিল, তাকে হাত করে, বসিয়ে দিয়ে আপাদমস্তক টুপিতে ঢেকে, ছেলে সেজে কীভাবে কলাবতী নিজে ব্যাট হাতে নেমে পড়ে এবং শেষে ঝোড়ো ব্যাটিং করে আটঘরাকে জিতিয়ে মান বজায় রাখে তাই নিয়েই টানটান গল্প।

২০০৯ সালে রিলিজ করা রানি মুখার্জীর ‘দিল বোলে হাডিপ্পা’ সিনেমাটি অনেকটা এই কাহিনির ছায়া অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল।

আরও পড়ুন
ফুলশয্যার রাতে, স্ত্রী’র কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চাইলেন তরুণ জীবনানন্দ

ক্রিকেট এবং দুই বনেদি পরিবারের উপাখ্যানের মিশেলে বড়ই সুখপাঠ্য এই উপন্যাস। কলাবতীর প্রেম না দেখালেও লেখক একটা অব্যক্ত প্রেমের ছোঁয়া রেখে গেছেন। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কলাবতীর স্কুল কাঁকুড়গাছি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস বা বড়দি মলয়া মুখার্জী। আর একটি চরিত্র সত্যশেখর, কলাবতীর কাকা। এই মলয়া মুখার্জী বকদিঘির জমিদারবাড়ির হরিশঙ্কর মুখার্জীর একমাত্র সন্তান। মলয়া এবং সত্যশেখর স্বাভাবিকভাবেই শিশুবয়স থেকেই একে অপরের পরিচিত। একটা আদ্যন্ত ছোটোদের লেখার মধ্যেই এই দুই মধ্যবয়েসী অবিবাহিত নারীপুরুষের অম্লমধুর সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে হাস্যরসের মোড়কে লেখক ছোটছোট ঘটনার জাল বুনে রেখে দিয়েছেন। তাতে প্রেমরসের উপস্থিতি এতই সূক্ষ, এতটাই অনুচ্চারিত যে পাঠকের পক্ষে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করা বড় সহজ কাজ নয়। এখানেই কলমের মুন্সিয়ানা, আদ্যোপান্ত কিশোর উপন্যাসের ভিতরও পরিণতমনস্ক পাঠক চাইলে কিঞ্চিৎ কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে চিনে নিতে পারবেন সেই ফল্গুধারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখক পরিণতি উহ্যই রেখে দিয়েছেন।

এবারে আসি আর একটা ইন্টেরেস্টিং ব্যাপারে। উপন্যাসে বর্ণিত এই দুটি গ্রাম আটঘরা এবং বকদিঘি এবং জমিদারবাড়িদুটি নিছক লেখকের কল্পনা নয়, বাস্তবে এর অস্তিত্ব আছে। হুগলি জেলার ধনেখালির খুব কাছে দুটি গ্রাম দশঘরা এবং চকদিঘী হল এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। দুটি গ্রামের নামে সামান্য অদলবদল করে লেখক উপন্যাসে জুড়েছেন।

দশঘরায় আছে বিশ্বাস পরিবারের জমিদারবাড়ি আর কাছেই চকদিঘী গ্রামে সিংহরায় পরিবারের বাড়ি। এই বিশ্বাসবাড়িতেই এসেছিলেন মতি নন্দী। তখনই এই বিশ্বাসবাড়ি এবং কাছের চকদীঘির সিংহরায়দের জমিদারবাড়িকে পটভূমি করে কলাবতী উপন্যাসের কথা তাঁর মাথায় আসে।

১৮শ শতকে ওড়িশা থেকে এসে দশঘরায় জমিদারির পত্তন করেন জগমোহন বিশ্বাস। তাঁর উত্তরসুরী সদানন্দ বিশ্বাস ১৮২৯ সালে জমিদারবাড়ি সংলগ্ন অসাধারণ টেরাকোটার কাজ সম্পন্ন একটি মন্দির তৈরি করেন কুলদেবতা গোপীনাথের জন্য। একটি দীঘি যার নাম গোপীসাগর, তার পিছনেই সাদা রঙের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের কাছারিবাড়ি, সামনে একটি রাসমঞ্চ আর দোলমঞ্চ, ডানদিকে নহবৎখানা, সব মিলিয়ে অসাধারণ সুন্দর কমপ্লেক্স। এই বাড়িতে এখনও  প্রতি বছর ধুমধাম করে দূর্গাপুজা আর রথযাত্রা পালন করা হয়।

চকদীঘির সিংহরায় পরিবারের বাড়িটিও খুব সুন্দর। বিরাট কমপ্লেক্সের মধ্যে ছটি ডরিক ঘরানার ফ্লুটেড থামওয়ালা দোতলা প্রাসাদ। একসময় এই পরিবারের অন্যতম প্রাণপুরুষ সারদা প্রসাদ সিংহ রায়ের আমলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এসে এই বাড়িতে থেকে গেছেন। পরবর্তীকালে মতি নন্দীর কলমেও যে এই জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য ছায়া ফেলবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!

Powered by Froala Editor

More From Author See More