দৃশ্যটা নতুন নয়। বরং বলা যায়, দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গেছে এই ছবি। নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো প্লাস্টিকের (Plastic) বোতল। থার্মোকল, বর্জ্য আর ওয়েস্ট ব্যাগে ভরে গেছে গোটা নদী। কয়েক স্থানে তো দেখা মিলবে না জলেরও। অথচ, ভ্রূক্ষেপ নেই কারোর। আশেপাশের বাড়ি থেকে টুপ করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগ। কোথায় দেখা মিলবে এই দৃশ্যের? সম্ভবত পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই। কিন্তু আপাতত কথা হচ্ছে গুয়াতেমালার (Guatemala) মোতাগুয়া (Motagua) নদীকে নিয়ে।
গুয়াতেমালার সবথেকে দীর্ঘ নদী মোতাগুয়া। একই সঙ্গে সবথেকে আবর্জনাযুক্ত। প্লাস্টিক দূষণের নিরিখে সারা পৃথিবীতে প্রথম সারিতে রয়েছে এই নদী। দেশটির পশ্চিম পার্বত্য অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়ে হন্ডুরাসের অববাহিকা পর্যন্ত প্রায় ৪৮৬ কিলোমিটার পর্যন্ত এর বিস্তার। কফি বা বিভিন্ন ফলের ছোটো জাহাজ অনবরত যাতায়াত করে এর উপর দিয়ে। নদীর দু পাশে ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সব জনপদে প্রায় কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। অথচ, প্রতি বছর ২০০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রবাহিত হয় নদী দিয়ে। যা সারা বিশ্বের মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের দুই শতাংশ। গ্রীষ্মে বা শীতে তাও একরকম। কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে বর্ষায়। দু-কূলে ছাপিয়ে বইতে থাকে প্লাস্টিকের ধারা। যার নামই হয়ে গেছে ‘ট্র্যাশ সুনামি’।
আর এই সমস্ত প্লাস্টিক গিয়ে মেশে ক্যারিবিয়ান সাগরে। এমনিতেও প্লাস্টিকের সমস্যায় সারা বিশ্ব জেরবার। বাড়ছে সামুদ্রিক দূষণ। তার মধ্যে মোতাগুয়ার পরিস্থিতি প্রকৃতির ভারসাম্য বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ নিয়ে হাজির হতে পারে। ইতিমধ্যেই এই নদী থেকে হারিয়ে গেছে মাছের ঝাঁক, কুমির আর জলজ প্রাণীরা। নদীর আশেপাশে দেখা মেলে না কোনো পাখির। দূষণের ফলে তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে লেগে থাকে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব। মশা-মাছি আর দুর্গন্ধের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো।
কিন্তু প্রশ্ন হল দায়ী কে? আঙুল উঠছে বড় কলকারখানাগুলোর দিকে। যাদের অনেকের কাছেই বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স নেই। নজর নেই সরকারেরও। ফলে নিশ্চিন্ত মনে নদী দূষণের কাজে হাত লাগিয়েছে তারা। তাছাড়া, গুয়াতেমালার বেশ কয়েকটি বড় শহর মোতাগুয়ার উপনদীর তীরেই অবস্থিত। যেগুলির নিকাশি ব্যবস্থার হাল অত্যন্ত সংকটজনক। হাজার হাজার টন প্লাস্টিক প্রতি বছর সেই উপনদীগুলি ধরে এসে মিশছে এখানে। সব মিলিয়ে যেন প্লাস্টিকের তোড়েই ভেসে রয়েছে মোতাগুয়া নদী।
আরও পড়ুন
নদীকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে লড়াই ‘যোদ্ধা’দের
অবশ্য কয়েক বছর হল নড়েচড়ে বসেছে দেশের সবপক্ষই। যার মূল কারিগর কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন। ‘40cean’ নামের একটি আমেরিকান সংস্থা বহুদিন ধরেই সরকার ও জনগণের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে। নিজেরাও নদীতে নেমে সরিয়েছে প্লাস্টিক। প্রথমে কাজ শুরু করেছিল মাত্র ২৫ জনকে নিয়ে। ক্রমে পাশে এসে দাঁড়ান অনেকেই। ২০১৯-এ একদিনে কুড়ি হাজার পাউন্ড প্লাস্টিক পর্যন্ত সরিয়েছে তারা। সরকার থেকেও নেমেছিল বেআইনি প্লাস্টিক নিষ্কাশনের বিরুদ্ধে তদন্তে। ‘Ocean Cleanup’ নামের নেদারল্যান্ডসের আরেকটি সংগঠন ২০২২-এ শুরু করেছিল নদীর বিভিন্ন বাঁকে ‘ট্র্যাশ ফেন্স’ বসানোর কাজ। এক ধরনের জালের সাহায্যে আটকে দেওয়া হবে প্লাস্টিক। কিন্তু সাম্প্রতিক বর্ষায় দেখা গেছে ‘ট্র্যাশ সুনামি’-র জোরে অনেক জায়গাতেই জাল ভেঙে গেছে। ফের শুরু হয়েছে প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ফিরে যাচ্ছে সেই আগের দিকেই। সমাধান কী? খুঁজছে সকলেই।
আরও পড়ুন
জলের পাউচ বাড়াচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ পদক্ষেপ ‘প্লাস্টিক ম্যান’-এর
Powered by Froala Editor