Powered by Froala Editor
সঙ্গীত, খেলা কিংবা যুদ্ধ - ভাই-বোনের যৌথতার কাহিনি লুকিয়ে সর্বত্রই
১/১১
গতকালই পেরিয়ে গেল ভাইফোঁটা। তবে ভাই-এর মঙ্গলকামনাতেই কি সীমাবদ্ধ থাকে বোনের ভূমিকা? প্রচলিত এই ধারণায় ফুটে ওঠে লিঙ্গবৈষম্যের কথা। তবে একাধিকবার প্রচলিত এই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। কখনও বিজ্ঞান, কখনও সাহিত্য, সঙ্গীত কিংবা যুদ্ধ— ভাই-বোনকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই পথ চলতে দেখা গেছে বহুবার। দেখা গেছে সাম্যের ছবি। দেখে নেওয়া যাক এমনই কিছু ভাই-বোনের গল্প, যাঁদের দ্বৈরথ কিংবদন্তি হয়ে রয়ে গেছে ইতিহাসে…
২/১১
হার্শেল ভাই-বোনের জুটি— ১৭৮১ সাল সেটা। সে-সময় গবেষকদের বিশ্বাস ছিল, ৬টি গ্রহ নিয়েই তৈরি আমাদের সৌরজগৎ। এই ধারণা ভেঙে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে দেন জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মহাকাশবিদ উইলিয়াম হার্শেল। সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। তাঁর আগে পর্যন্ত এই ইউরেনাসকে পৃথক কোনো নক্ষত্র বলেই ধরা হত। হার্শেল প্রমাণ করেন, পৃথিবী থেকে বহু দূরে অবস্থিত হওয়ায়, নক্ষত্রের মতো দপ দপ করতে দেখায় ইউরেনাসকে। তবে আদতে ইউরেনাসের আলো স্থির।
৩/১১
ইউরেনাস আবিষ্কারক হিসাবে উইলিয়ামের নামটিই খাতায়-কলমে পড়ি আমরা। তবে এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তাঁর বোন ক্যারোলিন হার্শেলও। উইলিয়ামকে টেলিস্কোপ তৈরিতে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ছিলেন উইলিয়ামের অন্যতম ছায়াসঙ্গী, বিজ্ঞান অন্বেষণের সহকারী। এখানেই শেষ নয়। বিশ্বের প্রথম মহিলা হিসাবে ধূমকেতু আবিষ্কার করেছিলেন ক্যারোলিন। তাঁর আবিষ্কৃত প্রথম ধূমকেতুটি আজ পরিচিত হার্শেল-রিগোলেট নামে। তবে একটি-দুটি নয়, সবমিলিয়ে ১৫টিরও বেশি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন তিনি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, সেই যুগে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানচর্চার জন্য বোনকে ৫০ পাউন্ড বাৎসরিক বেতন দিতেন স্বয়ং উইলিয়াম।
৪/১১
মোৎজার্ট ভাই-বোন— পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের কথা উঠলে মোৎজার্টের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। শৈশব থেকেই পিয়ানোর সুরের ঝংকারে গোটা বিশ্বে দোল তুলেছিলেন মোৎজার্ট। আজও তাঁর সুর অদ্বিতীয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, অস্ট্রিয়ান নাট্যকার সিলভিয়া মিলোর কথায়, ‘দুই মোৎজার্ট-এর আসলে বেশি প্রতিভাবান ছিলেন ন্যানারল।’ নামটি প্রথমবার শুনছেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ভলফগ্যাং মোৎজার্টের বড়ো বোন মারিয়া বিনোদন জগতে পরিচিত ছিলেন এই নামেই। বাবা এবং ভাই-এর সঙ্গে কৈশোরে গোটা ইউরোপে সঙ্গীত পরিবেশ করেছেন তিনিও।
৫/১১
শুধু মিলোর লেখাই নয়, খোদ মোৎজার্টও বোনের কম্পোজিশনের তারিফ করেছিলেন চিঠিতে। কুণ্ঠহীনভাবে জানিয়েছিলেন, মারিয়ার সঙ্গীতের সমতুল্য সুর এখনও বানানো হয়নি তাঁর। তবে মোৎজার্টের মৃত্যুর সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে রহস্য, তেমনই রহস্যজনকভাবে সঙ্গীত দুনিয়া থেকেই হারিয়ে যান মারিয়াও। এমনকি তাঁর তৈরি কোনো সুরই আর অবশিষ্ট নেই আজ। বিবাহ ঠিক হওয়ার পরই, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গীত সাধনা। তবে মোৎজার্টের প্রথম সিম্ফোনির পিছনে কৃতিত্ব রয়েছে তাঁরও, সে-কথা জানা যায় মোৎজার্টের চিঠি পড়েই।
৬/১১
খান ভাই-বোন— কিছুদিন আগের কথা। ব্রিটিশ সরকার, বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিল এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজকুমারীকে। নূর এনায়েৎ খান। সম্পর্কে তিনি টিপু সুলতানের প্রপৌত্রী। বলতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিকে বদলে দিয়েছিলেন এই ভারতীয় বীরঙ্গনা। ব্রিটেনের উইমেনস অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্সের বিমানচালিকা হিসাবে শুরু হয়েছিল তাঁর জীবন। পরবর্তীতে উইনস্টন চার্চিলের গোপন বাহিনী ‘স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ’-এর একাধিক অপারেশনে নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রথম মহিলা গুপ্তচর ও রেডিও অপারেটার হিসাবে নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। সেখানেই গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়েন তিনি। দিতে হয়েছিল প্রাণ।
৭/১১
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ সরকারের দৌলতে এনায়েৎ-এর গল্প প্রকাশ্যে আসলেও, আজও অন্ধকারেই রয়ে গেছেন তাঁর ভাই ভিলায়েৎ। বিশ্বযুদ্ধে বোনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়াই করেছেন তিনিও। তবে তাঁর লড়াইটা ছিল একটু অন্যরকমের। প্রাথমিকভাবে বোন নূরের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে নামার সিদ্ধান্ত নিলেও, পরবর্তীতে বাবা হজরতের মতোই সুফি সঙ্গীতকে হাতিয়ার করে নেন তিনি। গান্ধীর মতাদর্শে বিশ্বাসী ভিলায়েৎ সুফি সঙ্গীত এবং সংস্কৃতি প্রচারের মধ্যে দিয়েই শান্তি আনতে লড়াই চালিয়েছিলেন সে-সময়।
৮/১১
মঙ্গেশকর ভাই-বোন— সঙ্গীতের সূত্র ধরেই এবার ফিরে আসা যাক ভারতে। মহারাষ্ট্রের মঙ্গেশকর পরিবারকে বাদ দিলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় আধুনিক ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাস। মঙ্গেশকর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে লতা এবং আশা বিশ্ববন্দিত হলেও, সহোদর হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের জনপ্রিয়তাও কম নয়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম তিনিই।
৯/১১
মঞ্চ পরিবেশনা তো বটেই, একাধিক মারাঠি ও হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। ১৯৯১ সালে লেকিন ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কারও। এই ছবিতে তাঁর করা সুরেই কণ্ঠ দিয়েছিলেন দিদি লতা ও আশা। ২০০৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মাননাও পেয়েছিলেন হৃদয়নাথ। চলতি বছরেই প্রয়াত হন সুরসম্রাজ্ঞী। লতার শেষকৃত্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন হৃদয়নাথ।
১০/১১
তীরন্দাজ ভাই-বোন— সঙ্গীতের জগৎ থেকে এবার ফিরে আসা যাক খেলার দুনিয়ায়। ২০১০-এর কমনওয়েলথ গেমস। সেবার ভারতকে তীরন্দাজিতে চার-চারটি পদক এনে দিয়েছিলেন বরাহনগরের দুই ভাই-বোন। যাঁদের কথা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে একজন রাহুল ব্যানার্জ্জী ও অন্যজন দোলা ব্যানার্জ্জী। ২০১০-এর কমনওয়েলথ গেমসে দু’জনেই একটি করে সোনা ও ব্রোঞ্জ এনে দেন ভারতকে।
১১/১১
তবে এখানেই শেষ নয়, দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক তীরন্দাজির মঞ্চে দেখা গেছে রাহুল-দোলার দ্বৈরথ। বিশ্বকাপই হোক কিংবা এশিয়ান গেমস— দুই ভাই-বোনই একের পর এক সাফল্য এনে দিয়েছেন ভারতকে। দু’জনেই পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। ২০১৫ সালে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর যৌথভাবে স্পোর্টস ফাউন্ডেশন শুরু করেন দোলা ও রাহুল। আজও তরুণ তীরন্দাজদের দিশা দেখিয়ে চলেছেন বরাহনগরের ভাই-বোনের জুটি…