‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়…’ রবীন্দ্রনাথের লেখায় গ্রাম বাংলার যে বর্ণনা ফুটে উঠেছিল, তা উপলব্ধ করার সুযোগ নেই আজ। শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে সভ্যতার ক্যাকাফোনি আজ পৌঁছে গিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রাম, গহীন অরণ্যেও। শব্দ দূষণ থাবা বসিয়েছে পৃথিবীর সর্বত্রই। কিন্তু তার পরেও পৃথিবীর বুকে এমন পথ রয়েছে, যেখানে সারাদিন বিরাজ করে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। যে-পথের নৈসর্গিক অভিজ্ঞতা নিতে গেলে চোখ নয়, বরং খোলা রাখতে হয় কান।
তাইওয়ানের (Taiwan) কুইফেং লেক সার্কুলার ট্রেইল (Cuifeng Lake Circular Trail)। রাজধানী তাইপে থেকে ১৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ইলান কাউন্টিতে অবস্থিত এই লেক তাইওয়ানের বৃহত্তম অ্যালপাইন হ্রদ। এই হ্রদকে ঘিরে রেখেছে সুপ্রাচীন এক হাইকিং রুট। বয়স অন্ততপক্ষে কয়েকশো বছর। সম্প্রতি এই পথের মাথাতেই উঠল বিশ্বের সবচেয়ে শান্ত, নিশ্চুপ রাস্তার মুকুট। আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা কোয়াইট পার্কস ইন্টারন্যাশনাল (কিউপিআই) সম্প্রতি ঘোষণা করে এই স্বীকৃতির কথা। পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম রাস্তা হিসাবে কিউপিআই সার্টিফিকেটও পেল তাইওয়ানের কুইফেং লেক সার্কুলার ট্রেইল।
তাইওয়ানের এই রাস্তা যে কয়েকশো বছর পুরন, তা বলা হয়েছে আগেই। ফলে স্থানীয়দের কাছে এই পথ অতি-পরিচিত। তবে বছর দশক আগের কথা শব্দ-প্রযুক্তিবিদ লায়লা ফ্যানের সৌজন্যে প্রথম আন্তর্জাতিক চর্চায় উঠে এসেছিল এই পথের নাম। ন্যাচারাল সাউন্ড রেকর্ডিস্ট লায়লা এই রাস্তার মোট ৫২টি জায়গায় মাইক্রোফোন বসিয়ে রেকর্ড করেছিলেন প্রকৃতির আওয়াজ। আর সেই ফলাফল ছিল রীতিমতো অবাক করার মতোই। মানুষের পথ চলার শব্দও যেন শুনতে পাওয়া যায় না এই পথে। পাখির কলরবও মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে ওঠে এখানকার পরিবেশে। কিন্তু এমন হওয়ার কারণ কী?
সেই রহস্য সমাধানের খোঁজেই পথে নেমেছিলেন লায়লা। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারেন আদতে এই গোটা অরণ্যটাই কাজ করে একটি প্রাকৃতিক রেকর্ডিং স্টুডিও-র মতো। সাইপ্রেস গাছের ঘন অরণ্য এবং ভেজা মাটিতে পুরু মসের আস্তরণ শব্দশোষকের কাজ করে। ফলে অধিকাংশ শব্দই মিলিয়ে যায় সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করার পরেই। তাঁর গাণিতিক বিশ্লেষণে উঠে আসে এই অরণ্যে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা মাত্র ২৫ ডেসিবেল। যাকে প্রায় নিশ্চুপ বললেই চলে। স্থানীয় মানুষদের উপস্থিতির পরও এমন আশ্চর্য নীরবতা অবাক করার মতোই!
আরও পড়ুন
দুর্গম পথে একটানা ১৬ দিন দৌড়, নজির দুই অ্যাথলিটের
লায়লার এই গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর, ২০১৮ সালে দেশের সবচেয়ে ‘শান্ত রাস্তা’-র তকমা পেয়েছিল কুইফেং লেক সার্কুলার ট্রেইল। এবার তার মাথায় উঠল আন্তর্জাতিক মুকুট। তবে এই স্বীকৃতি হিতে বিপরীত হতে পারে নীরবতম রাস্তার ক্ষেত্রে, সেই আশঙ্কাই করছেন পরিবেশবিদরা। আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতির পরই বৈশ্বিক পর্যটকদের নজর কাড়বে এই পথ। বাড়বে জনসমাগম। তাতে এখানকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। তাই এই পথে হাঁটার সময়, সমস্ত যাত্রীদেরই মুখ বন্ধ রাখার আর্জি জানাচ্ছে তাইওয়ান প্রশাসন…
আরও পড়ুন
বিশ্বের ৬০ দেশের নাগরিক এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিশ্বের বৃহত্তম আবর্জনা-দ্বীপ ঘিরে নতুন বাস্তুতন্ত্র!