ঠিক যেন স্বপ্নরাজ্য। সাজানো-গোছানো বিলাসবহুল প্রকাণ্ড অট্টালিকা। এই বাড়ির সৌন্দর্য বা গঠনশৈলী যে-কাউকে মুগ্ধ করবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে এই বাড়ির ভেতরে ঢুকলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতে বাধ্য। বাড়ির নিচেই যে লুকিয়ে রয়েছে আস্ত একটি সামরিক গ্রেডের বাঙ্কার! সাধারণ বোমা তো বটেই, পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাত সহ্য করেও যা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে অনায়াসেই। সেখানে সঞ্চিত রয়েছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রী, মূল আবাসনের বাসিন্দাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা বিছানা। অথচ বাইরে থেকে দেখে এই বিপুল কর্মকাণ্ড অনুমান করার উপায় নেই কোনো।
সুইজারল্যান্ড (Switzerland)। মধ্যে ইউরোপের এই দেশটিতে গেলেই দেখা মিলবে এই দৃশ্যের। সেখানকার অধিকাংশ বাড়িতেই রয়েছে পারমাণবিক বিকিরণ প্রতিরোধক এ-হেন বাঙ্কার (Bunker)।
কথাটা শুনেই থমকে গেলেন নিশ্চয়ই? ইউরোপ তথা বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসাবেই পরিচিত সুইজারল্যান্ড। পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের কাছে কোনো পারমাণবিক অস্ত্রও নেই। এমনকি বছর কয়েক আগেই সে-দেশের প্রশাসন ঘোষণা করেছিল, তৈরি করা হবে না নতুন কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও। সৌরশক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা হবে বর্তমানে সক্রিয় থাকা পারমাণবিক চুল্লিগুলিকে। তবে তা সত্ত্বেও কেন অধিকাংশ বাড়ির নিয়েই নিউক্লিয়ার বাঙ্কার বানিয়ে রেখেছে মধ্য-ইউরোপের দেশটি?
এই উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৬০ বছর। ঠান্ডাযুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। পারমাণবিক শক্তিতে কে কতটা এগিয়ে রয়েছে— তারই প্রদর্শন করে চলেছে সোভিয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের কোনো-না-কোনো প্রান্তে প্রতিবছর চলছে শতাধিক পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা। সঙ্গে বিশ্বের সমস্ত দেশও ভাগ হতে চলেছে দুটি মেরুতে। কাজেই ফের বিশ্বযুদ্ধ লাগলে, গোটা ইউরোপ হিরোশিমা-নাগাসাকি হয়ে উঠতে পারে মুহূর্তের মধ্যে— তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
পারমাণবিক শক্তির এই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল না সুইজারল্যান্ড। তবে সুইজারল্যান্ড ভালোই বুঝেছিল মধ্য ইউরোপের দেশ হওয়ায় যুদ্ধের এই আঁচ এসে পড়বে তাদের ওপরেও। জার্মানি, রাশিয়া, কিংবা ব্রিটেনে পরমাণু বোমা ফেলা হলে, উত্তরের সাইবেরিয়ান হাওয়ার সঙ্গেই সেই বোমার বিকিরণ ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছেয়ে ফেলবে সুইজারল্যান্ডকেও। তৎক্ষণাৎ প্রাণ না হারালেও, ক্যানসার-সহ দুরারোগ্য রোগের প্রকোপে পড়বে কোটি কোটি নাগরিক। বড়োসড়ো ধাক্কা খাবে দেশের অর্থনীতি।
পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেই ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়েই নির্মীয়মাণ প্রতিটি বাড়িতে বাধ্যতামূলকভাবেই নিউক্লিয়ার বাঙ্কার নির্মাণের কথা ঘোষণা করে সুইস প্রশাসন। তাছাড়াও সরকারি ভবন, সেনাছাউনি এবং স্কুল-কলেজ-হাসপাতালের নিচেও গড়ে তোলা হয় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শেল্টার হাউস। তবে শুধু পারমাণবিক যুদ্ধই নয়, একইসঙ্গে পারমাণবিক চুল্লিতে আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা ভেবেও গড়ে তোলা এই পরিকাঠামো।
নব্বই-এর দশকে ইতি পড়ে ঠান্ডাযুদ্ধে। অথচ, তার পরেও দীর্ঘ দু’দশক এই আশ্চর্য নিয়ম জারি ছিল সুইজারল্যান্ডে। অবশেষে ২০১২ সালে বাধ্যতামূলকভাবে বাঙ্কার তৈরির আইনকে বাতিল করে সুইস প্রশাসন। অবশ্য খুব বেশিদিন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি তারা। গতবছর ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। অধিগ্রহণ করে ইউক্রেনের জাপোরজিয়া-সহ একাধিক পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র। ক্রমাগত বাড়তে থাকে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের হুমকি। এই অস্থিতিকর পরিস্থিতিতে ঠান্ডাযুদ্ধের সময় নির্মিত বাঙ্কারগুলি নতুন করে সংস্কার করার উদ্যোগ নেয় সুইসরা। ধুলো-ময়লা ঝেড়ে সেগুলিকে বাসযোগ্য করে তোলা হয় জরুরি ভিত্তিতে। অবশ্য এখনও পর্যন্ত তা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি তাদের। তবে এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, পারমাণবিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চিনকে ছাপিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত দেশ হয়ে উঠবেবে সুইজারল্যান্ডই…
Powered by Froala Editor