প্রচলিত ৮০০-র বেশি ভাষা, সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে দ্বীপরাষ্ট্র

ভারতের বুকে সরকারি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ২২টি ভাষা। তাছাড়াও কয়েকশো ভাষা এবং উপভাষার ছড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডজুড়ে। তবে ভারতের এই ভাষা বৈচিত্র্যও (Language Diversity) যেন ম্রিয়মাণ হয়ে আসে ছোট্ট একটি দ্বীপরাষ্ট্রের কাছে। পাপুয়া নিউ গিনি (Papua New Guinea)। এশিয়ার প্রান্তিকতম এই দ্বীপরাষ্ট্র আয়তনে ভারতের সাত ভাগের এক ভাগ। জনসংখ্যা মাত্র ৮৮ লক্ষ। তা সত্ত্বেও মহাসাগরীয় দেশে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে ৮৩৯টি ভাষা। 

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। বিশ্বের মোট ভাষার ১২ শতাংশের দেখা মেলে মাত্র ১.৭৮ লক্ষ বর্গ মাইলের এই ছোট্ট দেশে। যার মধ্যে রয়েছে ৮২০টি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা। এর বাইরেও অজস্র উপভাষার প্রচলন রয়েছে পাপুয়া নিউ গিনিতে। বলতে গেলে, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারত নয়, বরং পাপুয়া নিউ গিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ।

নিউ গিনির এই ভাষাবৈচিত্র্যের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। নিউ গিনিতে ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছিল আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে। সেসময় আনুমানিক প্রায় সাড়ে ছ’শোর বেশি পৃথক পৃথক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল নিউ গিনিতে। তাঁদের সংস্কৃতিও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলত, স্বাভাবিক নিয়মেই জন্ম নেয় অসংখ্য স্বতন্ত্র ভাষা। পাশাপাশি ভৌগলিক দিক থেকেও পাপুয়া নিউ গিনির অবস্থান, এশিয়া এবং ওশিয়ানিয়ার সংযোগস্থলে হওয়ায় পরবর্তী দু’হাজার বছরে অস্ট্রেনেশিয়ান ভাষা পরিবারের চল বাড়ে নিউ গিনিতে। সেসময় এই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা মূলত তাইওয়ান এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে পরিযায়ন করেছিলেন পাপুয়ায়।

তবে এখানেই শেষ নয়। পাপুয়া নিউ গিনির ভাষাবৈচিত্র্যের আরও বড়ো মোড়বদল হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। উনিশ শতকের শেষে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রে উপনিবেশ স্থাপন করে ব্রিটিশরা। বিশ শতকের শুরুতে যা হাতবদল হয়ে পৌঁছায় জার্মানদের কাছে। নিউ গিনিতে জার্মান ও ইংরাজির ব্যবহার শুরু সেইসময় থেকেই। তবে এই সংকটকালে পাপুয়া নিউ গিনির বুক থেকে মুছে গিয়েছিল শতাধিক স্থানীয় ভাষা।

আরও পড়ুন
ভারতীয় সাংকেতিক ভাষার শব্দকোষ, জড়িয়ে শাহরুখ খানও!

পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধের সময়ও পাপুয়া নিউ গিনির দখল নিয়ে টানাটানি চলেছে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মধ্যে। সেইসময়ও ভাষায় একাধিক বদল এসেছে ক্রম-পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পর, তিনটি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয় পাপুয়া নিউ গিনিতে। যার মধ্যে একমাত্র হিরি মতুই পাপুয়ার প্রাচীন ভাষাপরিবারের ভাষা। অন্য দুটি হল ইংরাজি এবং তোক পিসিন। তোক পিসিন ভাষাটি বিবর্তিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরেই। এই ভাষায় ৮০ শতাংশ শব্দই ইংরাজি শব্দকোষের।

আরও পড়ুন
১০৭টি ভাষা নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ জেলা বেঙ্গালুরু

আর বাকি প্রায় সাড়ে আটশো ভাষা? এক কথায় বলতে গেলে ভাষার এই বৈচিত্র্যময়তা আটকে রয়েছে গুটিকতক মানুষের মধ্যে। অধিকাংশ ভাষারই ব্যবহারকারীর সংখ্যা হাজারেরও কম। অর্থাৎ, সেগুলির অবস্থান বিপন্নপ্রায় ভাষার তালিকায়। অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে আড়াইশোর বেশি ভাষা। শুধু সাম্প্রতিক সময়েই নিউ গিনির বুক থেকে মুছে গেছে ১১টি ভাষা।

আরও পড়ুন
সিন্ধু সভ্যতায় দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা-ব্যবহার, হদিশ দিলেন বাঙালি গবেষক

অথচ, তারপরেও এই প্রাচীন ভাষাগুলির সংরক্ষণের কোনোরকম উদ্যোগই নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থারাও। একরকম অনিশ্চয়তার মধ্যেই যেন ডুবে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্রময় দেশের বৈচিত্রময়তাই। যার ভবিষ্যৎ পরিণতি ঠিক কী, তা জানা নেই কারোরই…

Powered by Froala Editor