বই-এর ব্যবসা তাঁর। আর সেই সূত্রেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয় তাঁকে। সংগ্রহ করতে হয় বিভিন্ন ভাষার বই। আর সেই কারণেই তিনি হাজির হয়েছিলেন ইতালির জেসুইট কলেজের বই বাজারে। সেখানে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে প্রাচীন সব পাণ্ডুলিপি। এতদিন সে-সব সংরক্ষিত ছিল ইতালির বড়ো বড়ো গ্রন্থাগারে। তবে খ্রিস্টধর্ম বর্জিত বাকি সব বই-ই ‘বাতিল’ করে ক্যাথলিক সংগঠন। বাছাই করে কিছু বই পোপের গোপন পাঠাগারে পাঠানো হয়। বাকিগুলি তুলে দেওয়া হয় বিক্রেতাদের হাতে। এই রত্নভাণ্ডার খুঁজতে গিয়েই আশ্চর্য এক গ্রন্থের সন্ধান পান তিনি। বিভিন্ন রঙের কালিতে লেখা এই গ্রন্থ। রয়েছে অসংখ্য ছবিও। কিন্তু কী ভাষার হরফ এগুলো? একাধিক ইউরোপীয় এবং এশিয় ভাষা জানা সত্ত্বেও এই হরফ চিনতে পারেননি তিনি। তবে এমন সম্পদ কি আর হাতছাড়া করা যায়? দীর্ঘ দর কষাকষির পর সামান্য মূল্যেই কিনে নেন বইটি।
যাঁর কথা হচ্ছে, সেই ব্যবসায়ীর নাম উইলফ্রেড ভয়নিচ। আর তাঁর খুঁজে পাওয়া এই আশ্চর্য গ্রন্থটি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ‘ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি’ বা ‘ভয়নিচ ম্যানুস্ক্রিপ্ট’ নামে। বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় গ্রন্থ হিসাবেই বিবেচিত হয় এই গ্রন্থটি। আজও যে গ্রন্থের পাঠোদ্ধার করতে পারেনি কেউ। কিন্তু কে এই গ্রন্থের রচয়িতা? কোন ভাষাতেই বা লেখা হয়েছে এই গ্রন্থ?
শুরু থেকেই বলা যাক এই রহস্যময় গ্রন্থের কাহিনি। ১৯১২ সাল। প্রথমবার এই গ্রন্থটি হাতে পেয়েছিল ভয়নিচ। তবে পোপের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, সেসময় বইটির কথা প্রকাশ্যে আনেননি তিনি। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন ভয়নিচ। মূলত সেখানেই তিনি গবেষণা চালিয়েছেন এই গ্রন্থ নিয়ে। ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের একটি কনফারেন্সে প্রকাশ্যে আসে এই বই। আর তারপরই গোটা বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে যায় এই গ্রন্থ নিয়ে।
চামড়ায় বাঁধানো ২৩৪ পাতার এই বইটি লেখা হয়েছে অজানা এক ভাষার হরফে। যার সঙ্গে গ্রিক বর্ণমালার মিল রয়েছে খানিকটা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার সঙ্গে চিনা বর্ণমালার সঙ্গে। এমনকি গ্রন্থের শেষের অংশটি লেখা হয়েছে চিনা ভাষার মতোই উপর থেকে নিচে। রয়েছে ড্রাগনের কথাও। সবমিলিয়ে এই গ্রন্থের কুলকিনারা করা এক দুঃসাধ্য। পাশাপাশি তার বিষয়বস্তুও বেশ অদ্ভুত। একদিকে যেমন তাতে রয়েছে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা, তেমনই মহাজাগতিক বস্তু, রাশিচক্র, চিকিৎসা— নদীর প্রতিটি ঘাটই ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে এই গ্রন্থ।
তবে শুধু গ্রন্থই নয়, এই গ্রন্থের সঙ্গেই আরও একটি আশ্চর্য জিনিস হাতে পেয়েছিলেন ভয়নিচ। আর তা হল একটি বিশেষ চিঠি। না, চিঠিটা অচেনা বর্ণমালার নয় অবশ্য। চিঠিটির লেখক জোয়ানেস মার্কাস মার্সি। এই চিঠিটির সঙ্গেই গ্রন্থটি পাঠোদ্ধারের জন্য তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর ইতালীয় বন্ধু অ্যাথানিয়াস কার্চারকে। অমৃত্যু তাঁর কাছেই ছিল এই বই। তবে রহস্য সমাধানে সাফল্য পাননি তিনি। পরবর্তীতে এই গ্রন্থ হাত ঘুরে পৌঁছায় কলেজিও রোমানোর জাদুঘরে।
অবশ্য মার্সির চিঠি অনুযায়ী, এই গ্রন্থের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও দীর্ঘ ইতিহাস। জড়িয়ে রাজা দ্বিতীয় রুডলফ। তিনিই নাকি এই গ্রন্থের মালিক। এমনকি গ্রন্থের ভেতরে রুডলফের এক সভাসদ জন ডি নামের এক ব্যক্তির স্বাক্ষরও খুঁজে পেয়েছিলেন ভয়নিচ। যা নিশ্চিত করে এই গ্রন্থের সঙ্গে জড়িয়ে জন ডি। অনুমান, তার আগে সপ্তদশ শতকের রসায়নবিদ বারেশের কাছে ছিল এই গ্রন্থ।
অবশ্য ভয়নিচ এই গ্রন্থ প্রকাশ্যে আনার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন এই গ্রন্থের সত্যতা নিয়ে। অনেকেই দাবি জানিয়েছিলেন, এই গ্রন্থের রচয়িতা স্বয়ং ভয়নিচ। কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য এই ফন্দি পেতেছেন তিনি। অবশ্য এই ঘটনা যে সত্য নয়, তা প্রমাণিত হয় বিশ শতকের শেষের দিকে। এই গ্রন্থের চারটি পাতাকে আলাদা করে পাঠানো হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ল্যাবরেটরিতে। সেখানেই কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে বয়স নির্ণয় করা হয় এই গ্রন্থের। জানা যায় এই গ্রন্থের বয়স প্রায় ৭০০ বছর। অর্থাৎ তা লেখা হয়েছিল চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতকে।
এখানেই শেষ নয়। লন্ডনের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ ডঃ গর্ডন রাগ নতুন করে গবেষণা শুরু করেন বিশ শতকের শেষে। তৈরি করেন অনুরূপ কাল্পনিক লিপি। যার মাধ্যমে আস্ত একটি গ্রন্থ রচনা করে তিনি দেখান, কোডিং বা সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে এমন গ্রন্থ নির্মাণ সম্ভব। অর্থাৎ, পরোক্ষভাবে প্রমাণ করেন, ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির মধ্যে নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে রয়েছে অর্থ। তবে সেই অর্থ কী, তা আজও উদ্ধার করতে পারেননি গবেষকরা। মানে খুঁজে পাননি সিআইএ, এমআই৬-এর তাবড় গোয়েন্দারা এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও। আবিষ্কারের ১০০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আজ রহস্যের কুয়াশায় মুড়ে রয়েছে প্রাচীন এই গ্রন্থ…
Powered by Froala Editor