আন্দিজ পর্বতমালার গা বেয়ে উপরে উঠে গেছে আঁকাবাঁকা এক রাস্তা। কোথাও কোথাও তার প্রস্থ মাত্র ফুট দশেক। রাস্তার ধারে নেই কোনো ব্যারিকেড কিংবা সেফটি পিলারও। একবার নিয়ন্ত্রণ হারালে, গ্রাস করে নেবে কয়েকশো ফুট গভীর খাদ। সেইসঙ্গে এই দুর্গম পথের দোসর গভীর আমাজন অরণ্য। ফলে, হিংস্র জীবজন্তুর ভয় তো রয়েছেই। এমন জায়গা অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমীদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই ভূস্বর্গ।
বলিভিয়ার (Bolivia) আন্দিয়ান শহর লা পাজ থেকে উত্তরের করোইকো গ্রাম— এই দুই অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র সংযোগই হল এই ভয়াবহ পথ। যাকে ঘাতক বললেও ভুল হয় না এতটুকু। বলিভিয়ার এই বিখ্যাত, থুড়ি কুখ্যাত রাস্তা পরিচিত ‘ক্যামিনো দে লা মুয়েরতে’ নামে। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘মৃত্যুর পথ’ (Death Road)।
হ্যাঁ, এই রাস্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জুড়ে রয়েছে প্রাণহানির গল্প। ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তা প্রতিবছর প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় ২০০-৩০০ জন মানুষের। পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। রাস্তার ধারে খাদে ছড়িয়ে রয়েছে বাস, ট্যাক্সি, লরি-সহ অসংখ্য মোটরগাড়ি। সংকীর্ণ রাস্তা, ১৮০ ডিগ্রি তীক্ষ্ণ বাঁক যেমন এইসকল দুর্ঘটনার কারণ, ঠিক তেমনই এই অঞ্চলে নিষ্ঠুর প্রকৃতিও। বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় এই রাস্তাটি সারাবছরই ঢাকা থাকে গভীর কুয়াশায়। শীতকালে গাড়ি চালকদের ক্ষেত্রে তাই আরও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে এই পথের গতিপ্রকৃতি। পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই ধ্বস নামে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে।
তবে শুধু ঘাতক চরিত্রই নয়, জন্মলগ্ন থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এই ‘ডেথ রোড’-এর। আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগের কথা। ১৯৩২ সাল। দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষী হয়েছিল বলিভিয়া। মারা গিয়েছিলেন ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সেই রক্তক্ষয়ী ‘চাকো’ যুদ্ধের সময়ই তৈরি হয়েছিল এই রাস্তা। তৈরি করেছিলেন প্যারাগুয়ের জেলবন্দিরা। পালানো এবং গা ঢাকা দেওয়ার জন্য গভীর আমাজন এবং দুর্গম পার্বত্য উপত্যকায় সংকীর্ণ পথকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। তা সত্ত্বেও সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছিল বহু কারাবন্দির।
পরবর্তীতে এই রাস্তার প্রস্থ বৃদ্ধি করার চেষ্টা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। আন্দিজের এই অঞ্চলে ভঙ্গুর ভূপ্রকৃতিই তার অন্যতম কারণ। অথচ, ততদিনে পাহার চূড়ায় গড়ে উঠেছে করোইকা গ্রাম। কাজেই এই বিপদসঙ্কুল পথই হয়ে ওঠে গ্রামবাসীদের একমাত্র আস্থা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁদের ব্যবহার করতে হয় এই পথ। আবার এই পথেই রাজত্ব চলে ড্রাগ মাফিয়া কিংবা লগারদের।
তবে ওই যে কথায় আছে না, পেটে খেলে পিঠে সয়। বলিভিয়ার ডেথ রোডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এই প্রবাদবাক্য। এই মৃত্যুর ফাঁদ পেরিয়ে পর্বতের শিখরে উঠতে পারলে আক্ষরিক অর্থেই স্বর্গদর্শন হবে যেকারোর। মুগ্ধ করবে শতাব্দী প্রাচীন ছোট্ট গ্রাম, নৈসর্গিক ভূপ্রকৃতি। প্রকৃতির এই ঘাতক সৌন্দর্যের আকর্ষণ এড়ানো সত্যিই কঠিন। আর সেই কারণেই বোধ হয় মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে প্রতিবছর এই পথে পাড়ি জমান হাজার হাজার পর্যটক…
Powered by Froala Editor