ইবন বতুতার দেশে - ৩

মরক্কোর হেঁসেলে পাওয়া যায় ইউরোপীয় ও আরব রন্ধনশৈলীর এক অদ্ভুত মিশেল। আর এটাই আলাদা করেছে মরক্কোর রান্নাঘরগুলোকে। রোম, ফ্রান্স, স্পেনের দখলে একসময় ছিল মরক্কো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার আগে থেকে গড়ে ওঠে মুসলিম শাসন। মরক্কোর রাজনৈতিক ইতিহাসই মরক্কোর রান্নার মধ্যে ঢেলে দিয়েছে এক অপূর্ব মিশ্র গন্ধ। তাজিনের গন্ধটাও সেরকমই।

তাজিন মরক্কোর অন্যতম প্রধান খাবার। তাজিন রান্নাতে ব্যবহৃত হয় এক অদ্ভুত অর্ধবৃত্তকার মাটির পাত্র। এই মাটির পাত্রটির নামই আসলে তাজিন। পাত্রের নামেই খাবারের নামকরণ। পৃথিবীতে এমন ক’টা খাবার আছে, যার নামকরণ তার পাত্রকে ঘিরে--তা জানা নেই। তাই, তাজিন শুধু জিভে জল আনে না, চোখে ঘনায় ঘোরও। মাটির পাত্রতে বিভিন্ন সবজি, মশলা, মাংস এবং মরক্কোবাসীর গোপন রেসিপি যোগ করে, আগুনের তাপে ভাপিয়ে তৈরি হয় তাজিন। ভেজ তাজিন, চিকেন তাজিন, মাটন তাজিন, বিফ তাজিন, ফ্রুট তাজিন— প্রত্যেক মরক্কোবাসীর খাবারের তালিকাতে থাকতেই হয় যেন। তাজিন শুধু মরক্কোর নয়, সমগ্র উত্তর আফ্রিকারই জনপ্রিয় খাবার।

এছাড়া রয়েছে ‘খুসখুস’, যব বা বার্লি দিয়েই তৈরি হয় এটা, সঙ্গে থাকে মাংস— যা জিভ গড়িয়ে জল ঝরাতে যথেষ্ট। মরক্কোর রাজপরিবারেরও নাকি অত্যন্ত প্রিয় এই খাবার। সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক মরক্কোয়, বাদশাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। মরক্কোবাসীদের কাছ থেকে জেনেছি, বর্তমান বাদশাহ ষষ্ঠ মহম্মদের রোজকারের খাবার তালিকায় তাজিন-খুসখুস থাকবেই।

‘তাজিন’ এবং ‘খুসখুস’ এর সঙ্গে আমার পরিচয় সাহিত্যপাঠের আসর চলাকালীন। সাহিত্যপাঠের আসর বসেছিল মরক্কোর দৌর স্‌বিটির ‘বাব জুইনা’-তে। ‘বাব জুইনা’-র বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘সৌন্দর্যের প্রবেশপথ’। আটলাস পর্বতের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। অঞ্চলের নামকরণ সার্থক। আসরের দিনগুলিতেই, ডাইনিং টেবিলে প্রথম আলাপ ‘তাজিন’ আর ‘খুসখুস’-এর সঙ্গে। মরক্কোর স্মৃতি প্রায় দু’মাস হতে চললো, কিন্তু বিশ্বাস করুন এখনও তাজিন-খুসখুসের স্বাদ ভুলতে পারেনি জিভের স্বাদকোষ।
বাব-জুইনায় সকাল ৭টার সেই রাজকীয় প্রাতঃরাশের কথা মনে পড়লেও কেমন যেন বিরহবোধ হয় আজকাল। ফ্রুট জুস, গোলা রুটির মতো তুলতুলে এক খাবার, তার সঙ্গে মধু কিংবা জেলি বা মাখন। এছাড়াও ডিমের অমলেট, চা-কফি। ১০টা-১১টার দিকে আবার চা, তার সঙ্গে মরক্কোর নানান ফল (আপেল, আঙুর, তরমুজ ইত্যাদি)। সে কী অপূর্ব স্বাদ! লাঞ্চের ঘণ্টা পড়ত ঠিক দুপুর ১টায়। টেবলে সাজানো থাকতো ব্রেড, চিজ, অলিভ অয়েল। তার সঙ্গে আসত পনির-স্যালাড, তাজিন কিংবা খুসখুস। শেষ পাতে ডেজার্ট হিসেবে তরমুজ বা মিষ্টি।

রাতে ডিনার হত ৮টায়। আর এখানেই যত অসুবিধে। আমার মতন যেসব বাঙালি আসরে ছিলেন, তারা কেউই রাত ৮টায় ডিনারের কথা ভাবতে পারতেন না৷ ডিনারে থাকত খুবই অল্প খাবার। ব্রেড, চিজ, ওলিভ অয়েলের পাশাপাশি স্যালাড, ক্যারট স্যুপ বা চাউমিন। ভাতের কাঙাল দু’দিনের বাঙালি অতিথিরা ভাতের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকত। ভাত অবশ্য আসতও মাঝে-সাঝে। সেদিন আমরা জমিয়ে খেতাম।

চা-কফি প্রিয় মানুষদের জন্য মরক্কো হতে পারে এক বাদশাহী ‘কফি হাউস’। কফির জন্য বিখ্যাত এই দেশ। এছাড়া রয়েছে ভার্ভেনা টি, মিন্ট টি। এই দুই ফ্লেভারের চা-ই মরক্কোবাসীর সবচেয়ে পছন্দের। চা-এর এমন গন্ধ, এমন স্বাদ ভারতবর্ষের কোথাও পাওয়া যায় না। মরক্কোবাসীরা অবশ্য একে ‘রিফ্রেশমেন্ট ড্রিঙ্ক’ বলে। এই চায়ের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এই যে, এ আপনার মেজাজ-মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। সকালে ঘুম থেকে উঠে, দুপুরের ব্রেক টাইমে, লাঞ্চের পরে, সান্ধ্য আড্ডায়, ডিনারের শেষে ‘চা’ আমাদের পানীয়-অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সেই চা নিয়েও এসেছিলাম বন্ধু-পরিবারের জন্য। দুঃখের কথা, পাঠকের জন্য আর বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না কিছুই-- শুধু কথায় বোনা অভিজ্ঞতা ছাড়া।

আসর নিয়েই ব্যস্ততা ছিল রোজ। তবুও, ফাঁক খুঁজে বেরিয়ে পড়তাম বাজারে। জেলেবা, বাবৌচি কিনেওছি নিজের জন্য ২৫০ ডিরহাম ও ৬০ ডিরহামের বিনিময়ে। শুনেছিলাম, মরক্কোবাসীরা দাম-দর পছন্দ করেন না। কিন্তু, তাই বলে তো কোনো বাঙালি ‘বার্গেনিং দক্ষতা’ প্রয়োগে পিছয়ে আসে না! আমিও আসিনি। কিন্তু, মরক্কোবাসীদের কী বলে মন জয় করা যায়? ইন্ডিয়া বলতে তারা কী বোঝে? এইসব গ্রাউণ্ড ওয়ার্ক করার জন্য সার্ভে করতে শুরু করলাম স্বল্প পরিসরে। একজন মরক্কোবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘হোয়াট ডু ইউ নো আবাউট ইন্ডিয়া’? উত্তর এল- ‘উম, ইন্ডিয়া? ইউ মিন দা ল্যান্ড অব বাদশা?’ কিন্তু কে এই ভারতীয় বাদশা? উত্তর পেতে বেশি দেরি হল না…

(ক্রমশ)

প্রথম পর্ব
ইবন বতুতার দেশে - ১

দ্বিতীয় পর্ব
ইবন বতুতার দেশে - ২