‘খাজা বাবা খাজা বাবা, মারহাবা মারহাবা, গেয়েছিলেন নবীর গুণগান’— ফকিরি এই গানের ‘মারহাবা’ যে একটা আরবি শব্দ এবং তা ‘সম্ভাষণ’ অর্থে প্রচলিত, বুঝলাম মরক্কোতে পৌঁছে। মরক্কোর আন্তরিকতা, আথিতেয়তার ‘মারহাবা’ অচিরেই আমাকে তাদেরই একজন করে তুলল। মরক্কোবাসীরা প্রধানত কথা বলেন ‘আরবি’ আর ‘ফ্রেঞ্চ’ ভাষায়। এছাড়াও ‘বার্বার’ বা ‘স্প্যানিশ’ ভাষাতেও কথোপকথন চলে দেশের বেশ কিছু অংশে। যেদিন মরক্কোর ম্যারাকেশে পৌঁছলাম, তার পরের দিন ভোর ৬টায় ঘুম ভেঙে বেরিয়ে দেখি আকাশ তখনও কালো। ভাবলাম, একটু যদি বাইরে বেড়িয়ে দেখতে পারতাম! কিন্তু, রেয়াদের গেটে তখনও নিশ্চয়ই তালা ঝোলানো, আর এই সময় ওদের জাগিয়ে গেট খোলানো উচিত নয়—এসব ভাবতে ভাবতেই দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখি দরজায় কোনও তালা নেই, এমনকি ছিটকিনিও দেওয়া নেই, ভেজানো ছিল মাত্র। আমার তো অবাক হওয়ার পালা।
পরে জানতে পারলাম, মরক্কো ‘চুরি’ বা ’ডাকাতি’র মতো শব্দগুলোর সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। তাই, বিনা দ্বিধায় দরজা ভেজিয়েই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। সেদিন সূর্য উঠল সকাল ৭টায়, মরক্কোবাসীরা আরেকটু পরে, ৮ টা নাগাদ। সকাল ৮টা থেকেই শুরু হয় মরক্কোর জীবন-চলাচল। কফি সহযোগে পাঁউরুটি-চিজ খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম মরক্কোর চলাচলকে জানতে-বুঝতে, অভিজ্ঞতার সিন্দুকে পুরতে।
মরক্কোর আয়ের বেশ অনেকটাই নির্ভর করে পর্যটনের ওপর। পৃথিবীর নানান দেশ থেকে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে বছরভর। আমিও সেই দলে ভিড়ে গেলাম। দেখার জিনিসের অভাব নেই এই দেশে। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-কারাওয়াইন’ বিশ্ববিদ্যালয়টি মরক্কোর উত্তরাঞ্চলের ‘ফেস’ শহরে অবস্থিত। ৮৫৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করে ফাতিমা-আল-ফিহরিয়া। দেশের রাজধানী ‘রাবাত’ হলেও, সেপিয়া টোনের শহর ‘ম্যারাকেশ’ ছিল মরক্কোর পূর্বতন রাজধানী। মরক্কো দেশের নামকরণও ‘ম্যারাকেশ’ থেকেই। আর এই দেশের সবচেয়ে বড় শহর বন্দরনগরী ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’। ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরেই রয়েছে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম মসজিদ, ‘হাসান মসজিদ’। এটা লাল বেলে পাথরে তৈরি, যার নকশা এঁকেছিলেন ফরাসি স্থপতি মিশেল প্যাসো। মরক্কোর ‘ফেস’ শহর ইউনেসকোর ঐতিহ্য-তালিকায় আছে। এছাড়াও রয়েছে মরক্কোর প্রাচীনতম শহর ‘তাঞ্জির’। রয়েছে প্রাচীন রোমান শহর ভোলুবিলিসের ধ্বংশাবশেষও। এই প্রত্যেকটি শহরের নিজের নিজের গল্প আছে, সৌন্দর্যের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সেইসব গল্প শুনতেই ছুটে আসতে হয় মরক্কোয়। ইতিহাসপ্রেমীদের নয় শুধু, পর্বতারোহীদেরও প্রিয় এই দেশ। অতন্দ্র প্রহরায় দেশের উপরে মহাকালের মতো দাঁড়িয়ে আছে ‘আটলাস’ পর্বতমালা। টিউবকাল মরক্কোর সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, উচ্চতা ১৩ হাজার ৬৬৫ ফুট।
আমার মরক্কো-সফর জুড়ে ছিল প্রধানত একটাই শহর, ম্যারাকেশ। আটলাস পর্বতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্নিগ্ধ, লালচে হলুদ শহর। গোটা ম্যারাকেশ শহরটাই ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। জেমা এল ফনা, মেদিনা, মাজোরেলে গার্ডেন, কুতুবিয়া মস্ক, বাহিয়া প্যালেস, সাদিয়ান টম্ব, এল বাদি প্যালেস, বেন ইউসুফ মাদ্রাসা, ম্যারাকেশ মিউজিয়াম সহ রয়েছে দেখার অজস্র বিষয়। রয়েছে বিভিন্ন বাজার- দেজেমা এল ফানা, মেলা, সোক চেরিফিয়া, সোক এল আটারিনে। লেদারের জন্য সোক স্মাটা আর লণ্ঠনের জন্য বাব-এল-খেমিস উল্লেখ্য। বাজার এমন একটা বিষয়, যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না। মানিব্যাগের ডিরহামগুলোতে চোখ বুলিয়ে তাই ঢুকে পড়তেই হয় ম্যারাকেশ বাজারে। অর্গ্যান ওয়েল, বাবৌচি (মরক্কোবাসীর ঢেউ খেলানো জুতো), লেদার ব্যাগ, রঙিন গ্লাস, জেলেবা (মরক্কোবাসীর পোশাক), বার্বার বাস্কেট, হাতে তৈরি সাবান, লণ্ঠন, কার্পেট, পটারি, সুগন্ধী, বিভিন্ন খাবারের মশলা— মরক্কোর বাজারগুলো এসব জিনিসের প্রলুব্ধ করে রাখে বিদেশি পর্যটকদের।
মরক্কোর মুদ্রা ডিরহামের মূল্য ভারতীয় মুদ্রার প্রায় সাতগুণ। অর্থাৎ, ১ ডিরহাম ভারতীয় মুদ্রায় ৭ টাকা। সাত দিয়ে গুণ করতে করতে তাই আমাকে এগোতে হচ্ছিল বাজারের রাস্তা বরাবর। প্রথম দিন কিছু কেনা হল না, দামগুলো শুধু জেনে নেওয়া ছাড়া। এদিকে তখন খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড। দূর থেকে নাকে ভেসে এল ‘তাজিনের’ গন্ধ…
(চলবে)
আরও পড়ুন
ইবন বতুতার দেশে - ১