ইবন বতুতার দেশে

প্রথম পর্ব

‘পাগল রাজা’ মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে এসেছেন ইবন বতুতা। প্রায় ৭০০ বছর কম বয়স তখন পৃথিবীর। দিল্লিতে দূষণের ছিটেফোঁটাও নেই। গোটা পৃথিবীর অনেকটাই সবুজ। ভারতবর্ষের এই শ্যামলিমা দেখে মুগ্ধ হন পণ্ডিত পর্যটকটিও। তাঁর দেশের রং যে রুক্ষ হলদেটে। সেই সুদূর মরক্কো থেকে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসেছেন দিল্লির সুলতানের দরবারে। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁকে বসিয়েছেন ‘কাদি’-র পদে। এই দেশের থেকে নানা স্মৃতি নিয়েই এগিয়েছেন ইবন। আর তাঁর নিজের দেশ? সেই রহস্যময় মরক্কো!

মরক্কো যাওয়ার সুযোগ যে চলে আসবে, তা মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না। অথচ এল। চিকাগো ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে এ’বছর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যপাঠের আসর বসেছিল উত্তর আফ্রিকার এই বাদশাহির দেশেই। সেই সাহিত্যপাঠের আসরে দেশ-বিদেশের নানা গুণীজনের পাশাপাশি আমন্ত্রণ জুটে গেল আমার ভাগ্যেও। সে এক অভিজ্ঞতা! একদিকে, আসর থেকে ছেনে নিচ্ছিলাম জীবনের মহামূল্য সব পাঠ, আর তারই পাশাপাশি মরক্কোর জল-বায়ু-মাটির সংস্পর্শে জীবনের এগারোটা দিন আমার মতো আপাদমস্তক ভেতো বাঙালির জীবনও হয়ে উঠেছিল বাদশাহি মেজাজের। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পাঠের আসরে ফ্রান্স, ইতালি, চেক, রাশিয়া, আমেরিকার মতো দেশ থেকে যোগ দিয়েছিলেন পণ্ডিত সব মানুষ, বাংলা ভাষায় যাঁদের পাহাড়-প্রমাণ দক্ষতা দেখে বিস্ময়ে নতজানু হতে হয়। নিজের কানে না শুনলে বা না দেখলে বিশ্বাস করে ওঠাই বেশ কঠিন। যাহোক, সেই সাহিত্য পাঠের আসরের অভিজ্ঞতা আজ লেখার বিষয় নয়, লেখা বারণও আছে। বরং, বিস্ময়ের দেশ মরক্কোকে কেমন দেখলাম, মানুষজনের সাথে কী কথা হল, কী নিয়ে ফিরলাম মরক্কো থেকে—সেই গপ্পই বলি।

কলকাতা বিমানবন্দর থেকে কাতারের দোহা, তারপর দোহা থেকে ম্যারাকেশ—দীর্ঘ আকাশ পথ পেরিয়ে, জানলার কাঁচ দিয়ে অজস্র রেখা-বৈচিত্র-মেঘের পাশ কাটিয়ে পৌঁছে যাওয়া এক সম্পূর্ণ অন্য মহাদেশে, আফ্রিকায়। বনস্পতির নিবিড় পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকা ইতিহাসের আফ্রিকা। মানবজাতির এই আঁতুড়ঘরে, যেখানে আজ থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ বছর আগে আদিমানবেরা এপ-জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছিল- সেই গর্ভদেশের পবিত্র ভূমি ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হল অবশেষে। নীল নদ-মিশরীয় সভ্যতার আফ্রিকা, প্রথম বর্ণমালা হায়রোগ্লিফিকের আফ্রিকা, মহাদেশের মাঝখান বরাবর চলে যাওয়া নিরক্ষরেখার আফ্রিকা, ‘সিয়েরা লিওন’-এর অন্যতম সরকারি ভাষা ‘বাংলা’র আফ্রিকা---এক কথায় বিস্ময়ের আফ্রিকা।

দু-সপ্তাহের জন্য আমাদের অস্থায়ী ঠিকানা ছিল মরক্কো। মরক্কোর আরবি নাম- আল-মামলাকা আল-মাগরিবিয়া, যার অর্থ ‘পশ্চিমের রাজ্য’। আটলান্টিকের কোল ঘেঁষে আফ্রিকার সবচেয়ে পশ্চিম সীমান্তের দেশ এই মরক্কো। মরক্কো নামটি এসেছে পূর্বতন রাজধানী মারাক্কেশ থেকে, ‘বার্বার’ ভাষায় যার অর্থ ‘স্রষ্টার দেশ’। একদিকে আটলাস পর্বতমালা, অন্যদিকে সাহারা মরুভূমি-- তার মাঝে বয়ে নিয়ে চলা কতযুগের সভ্যতার আখ্যান। মরক্কোর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন৷ সেই ‘প্যালিওথিলিক’ যুগ থেকে মরক্কোতে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘আল-কারাওয়াইন’, প্রাচীন রোমান শহর ভোলুবিলিসের ধ্বংসাবশেষ, কাসাব্লাঙ্কা শহরের হাসান মসজিদ সহ নানান স্থাপত্য-ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই দেশ৷ গোটা দেশটাই যেন হলদেটে বাদামি বা সেপিয়া টোনের পোস্টকার্ডের মতো। ‘দ্য মামি’, ‘প্রিন্স অব পারসিয়া: দ্য সাউন্ডস অব টাইম’, ইনসেপশন, মিশন ইমপসিবল—রাউজ নেশন, ক্যাসাব্লাঙ্কার মতো বিখ্যাত সব হলিউডি সিনেমার এই দেশে। এমনকি ‘গেম অব থ্রোনস’-এর অনেকটাও মরক্কোতেই শ্যুট করা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুভি সেট এই দেশ।

২ তারিখ ভোর রাতে রওনা হয়েছিলাম মরক্কোর উদ্দ্যেশে, পৌঁছলাম পরের দিন সন্ধে ৮টা নাগাদ। এদিকে তখন বিকেলের রোদ্দুর ঝলমলে। রাত ৯টায় সূর্য ডুবল মরক্কোয়। রাস্তার বাম দিক ঘেঁষে চলাচলের যে প্রাচীন শিক্ষা তাও হোঁচট খেল এ-দেশের রাস্তাতে। বুঝলাম, এখানে সুরক্ষা ডান দিক ঘেঁষে চলাতেই। ট্যাক্সি বা গাড়ির ড্রাইভারের সিটও আমাদের বিপরীত। গাড়িতে উঠে হোটেল যাওয়ার পথে আবিষ্কার করলাম রাস্তা-ঘাটও সম্পূর্ণ আলাদা আমাদের দেশের নিরিখে। রাস্তার কোথাও এক ফোঁটা নোংরাও পড়ে নেই। আসর বসতে তখনও দু’দিন দেরি। এই দু’দিন তাই মরক্কোকে নিজের মত করে জেনে নেওয়ার সময়। আমার ঠিকানা তখন ওল্ড মেডিনার এক রায়াদ। সেই রায়াদের উদ্দেশ্যেই এয়ারপোর্ট থেকে চলেছি রাতের রাস্তা ধরে। দৃশ্যমান যা কিছু তার সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছি নিজের পরিচিত দেশ-কালকে। অনেক মিল এবং বহু বৈচিত্রকে দেখতে দেখতেই এগিয়ে চললাম রায়াদের দিকে।

আমি যে ইবন বতুতার দেশে, সে-কথা তখনও মোটে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।

(ক্রমশ)

Latest News See More