একটা পেল্লায় সাহেব বাংলো। বয়স নব্বই। দুরপিনদাঁড়া পাহাড়ের টঙে, সবুজে মোড়া লনের ওপর দাঁড়িয়ে রাজার মতো। সবুজ লনের চারপাশে নানা বাহারি ফুল। পায়রা বকবক বকম। আর লনের এককোণে গেলেই দেখা যাবে আকাশে বড় আয়েশ করে গা এলিয়ে শুয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বাংলোটাকে এড়িয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে প্রেমের ঘোর লাগবে। তারপরে দুরুদুরু বুকে ফের যদি তাকান বাংলোর দিকে, ছ্যাঁত করে উঠবেই বুকটা। ভূতে বিশ্বাস করেন না, চারপাশে ঝকঝকে রোদ, লনে উল গায়ে কুকুরছানা খেলছে। তারপরেও ভয় করবে।
মরগ্যান হাউস এমনই। গেট ছাড়িয়ে ঢুকলেই মনে হবে একটা ভূতুড়ে পোড়ো বাড়ি। বাড়ির গা জুড়ে শিকড়-বাকড়, লতানে গাছের সারি। পাথুরে বাংলোটাকে যেন জড়িয়ে রেখেছে সবুজ। অথচ, এই বাংলোই কালিম্পঙের অন্যতম সেরা হোটেল। তাও আবার খোদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্পত্তি। ভিতরে ঢুকলেই রাজকীয় বিলাসের আঁচ মিলবে। সাহেবি কেতার ‘ফায়ার প্লেস’, বড় বড় ঘর, উঁচু দেওয়াল, কাচের জানলা, দেওয়ালে পুরনো ছবি। প্রাথমিক ভয়টা কাটিয়ে বাইরে থেকে বাংলোকে দেখলেও মুগ্ধ হতে হবে। ব্রিটিশ কাঠামোর বাংলো। পাথুরে দেওয়াল। মনে হবে ব্রিটেনের কোনও কাউন্টিতে চলে এসে এসেছেন। তারপরেও অবশ্য ভয়টা কাটবে না। কারণ আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন, এই মরগ্যান হাউস ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ‘ভূতুড়ে ঠিকানা’।
১৯৩০ সালে এই সাধের বাংলো তৈরি করেছিলেন জর্জ মরগ্যান। পাটের ব্যবসা ছিল তাঁর। দেদার টাকা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তিও মন্দ ছিল না। তখন তিন কিমি দূরের কালিম্পং শহর অনেকটাই আয়তনে ছোট। লোকজন কম, প্রকৃতি আরও উদার। এমন জায়গার প্রেমে না পড়ে থাকা যায়! মরগ্যান সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে এসে উঠলেন এই বাংলোয়। গ্রীষ্মে তো বটেই, পারলে সারা বছরই কাটান এখানে। একসময় সাহেব মারা গেলেন, তাঁর প্রিয়তমাও চোখ বুজলেন। নিঃসন্তান দম্পতি কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। ফলে, এই বাংলো চলে এল ভারত সরকারের হাতে। ১৯৬২-তে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু যখন অসুস্থ, ঠিক হল এই বাংলোটিকেই সরকারি রেস্ট হাউসে পরিণত করা হবে। নেহরুজিও থাকবেন, পাহাড়ি আবহাওয়ায় সেরেও উঠবেন দ্রুত। কিন্তু, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই নেহরুর মৃত্যু। অতঃপর, ১৯৭৫ সাল নাগাদ এই বাংলো পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের হাতে আসে। আর, এখন তো ‘মরগ্যান হাউস’ কালিম্পঙের অন্যতম বিখ্যাত হোটেল।
কিন্তু, এই গল্পে ভূত কই? স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পাবেন। শোনা যায়, লেডি মরগ্যান অদ্ভুত ভালোবাসতেন এই বাড়িকে। মৃত্যুর পরেও তাঁর সেই প্রেম ঘোচেনি। এখনও নাকি তিনি প্রায়ই দেখা দেন। ঘুরে বেড়ান হোটেল থুড়ি বাংলোর করিডরে, এমনকি ঘরেও ঢোকেন। সাদা গাউন পরিহিতা লেডি মরগ্যানকে অনেকবার দেখেছেন বাংলোর পাহারাদারেরা। তাঁর এবং মরগ্যান সাহেবের শোওয়ার ঘরে যে-সব অতিথিরা থাকেন, তাঁদেরও নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে অতীতে। এমনও জনশ্রুতি রয়েছে, পর্যটকদের মাথায় নাকি হাতও বুলিয়ে দিয়েছেন লেডি মরগ্যান। মরগ্যান হাউসেরই এক মহিলা কর্মচারী গভীর বিশ্বাসে বলছিলেন, কোজাগরী পূর্ণিমায় মেমের সাক্ষাৎ পাওয়ার সম্ভাবনা নাকি সবচাইতে বেশি। একদা ভারি অতিথিপরায়ণা লেডি মরগ্যান তাঁর বাংলোর অতিথিদের ঠিকমতো যত্ন-আত্তি হচ্ছে কিনা, তা সরেজমিনে পরীক্ষা করতে বেরোন। তাঁর পায়ের শব্দ এখনও শুনতে পান আবাসিকরা।
তবে, বিদেহী লেডি মরগ্যান যে কারও কোনও ক্ষতি করেননি কখনও, তা একবাক্যে মেনে নেন কালিম্পঙের সকলেই। ভয় পেয়ে কোনও কোনও পর্যটক পরের দিনই ঘর বদলে নিয়েছেন বা বাংলো থেকেই পাততাড়ি গুটিয়েছেন, এমন ঘটনাও অবশ্য কম নয়। আবার, কেউ কেউ এই রোমাঞ্চের টানেই আসেন মরগ্যান হাউসে। বহুবার রাত কাটিয়েও এখানে ভূতের ভ-ও দেখতে পাননি, এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। তাঁরা মনে করেন, গোটাটাই রটনাজনিত বিভ্রম। বিপরীতপক্ষের মানুষরা একদম উল্টো কথা বলেন। এই সবটা মিলিয়েই ‘মরগ্যান হাউস’কে ঘিরে ঘোর আরও ঘন হয়।
আর এই ভূতুড়ে গপ্প-বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে বাংলোকে ঘিরে লুটিয়ে থাকে প্রকৃতি। সামান্য নিচে কালিম্পং শহর, আকাশের গায়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাছেই দুরপিনদাঁড়া মনাস্ট্রি। অনেকটা নিচে বয়ে চলেছে তিস্তা। শহরের মূল কেন্দ্র থেকে দূরে হওয়ায় আর কাছেই আর্মি ক্যাম্প থাকায় গাড়ি-ঘোড়ার উৎপাতও তেমন নেই। ভূতুড়ে রোমাঞ্চের টানে না হোক, প্রকৃতির আর আভিজাত্যের টানে এই বাংলোয় যে ঢুঁ মারতেই হবে আপনাকে।