ধু-ধু মরুভূমির উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা জীর্ণ চেহারার মরচে ধরা লোহার স্টিমার, ট্রলার, জাহাজ। সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইন্টারনেটে এই দৃশ্য চোখে পড়েছে অনেকেরই। না, কোনো সিনেমার সেট নয়। বাস্তবেই একসময় এই অঞ্চলে অবস্থিত ছিল আস্ত একটি সমুদ্র। আরাল সাগর। উজবেকিস্তানের এই জলাশয় আদতে একটি হ্রদ হলেও, প্রকাণ্ড আয়তনের জন্য ‘সাগর’ হিসাবেই ধরে নেওয়া হত তাকে। অথচ, বর্তমানে মাত্র এক দশমাংশ অবশিষ্ট রয়েছে ৬৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই প্রকাণ্ড জলাশয়ের। বাকি অংশ পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে।
অবশ্য শুধু আরাল সাগরই নয়, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত অন্যান্য হ্রদের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মিষ্টি জলের হ্রদ (Lakes) এবং জলাশয়ের (Waterbodies) দ্রুত হারে শুকিয়ে (Drying Up) যাচ্ছে বলেই অভিমত গবেষকদের। ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণা সতর্ক করছে আগামীদিনে ভয়াবহ জলাভাবের সম্মুখীন হতে চলেছে মানব সভ্যতা।
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই নদীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় প্রতি বছর। অথচ, হ্রদ বা প্রাকৃতিক জলাশয়ের দিকে একইভাবে নজর দেয় না রাষ্ট্রের প্রশাসনরা। কিন্তু আদৌ কতটা সুস্থ রয়েছে বিশ্বের হ্রদগুলি? আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। এই প্রশ্ন থেকেই সূত্রপাত হয়েছিল এই গবেষণার। নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানী ফ্যাংফ্যাং ইয়াও। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, কানাডা, সৌদি আরব, ভারত, চিন এবং ইউরোপ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল একটি বিশেষ দল।
১৯৯২-২০২০— দীর্ঘ তিন দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন জলাশয়ের ওপর স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নজরদারি চালান তাঁরা। নথিভুক্ত করেছিলেন হ্রদের গভীরতা, উপরিপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল, জলের পরিমাণ, গুণগত মান-সহ একাধিক রাশিকে। ২০২০ সালের পরে এই তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করতে গিয়েই গবেষকদের নজর কাড়ে দ্রুত জল শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে গভীরতা এবং উপরিতলের ক্ষেত্রফল কমছে বিশ্বের ৫৩ শতাংশ প্রাকৃতিক হ্রদের। যার অর্থ, দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে এই হ্রদগুলি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনও বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষের বসবাস হ্রদ কিংবা জলাশয়ের ধারে। এমনকি শুধু বিগত ৩ দশকেই, এই গবেষণা চলাকালীন প্রতি বছর গড়ে ২২ গিগাটন করে জল উবে গেছে প্রাকৃতিক হ্রদ ও জলাশয় থেকে। যা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম হ্রদ লেক সুপিরিয়রের মোট আয়তনের সমান।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো বোল্ডার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণাপত্রের সহ-লেখক বালাজি গোপালনের কথায়, এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে সভ্যতার ওপর। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন বিভিন্ন হ্রদের অববাহিকায়। হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে চলেছে বলেই জানাচ্ছেন তিনি। দেখা দিতে পারে চরম জলসংকট। ব্যাহত হতে পারে কৃষিকাজও।
আগামীদিনে বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিমাণ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাত্রা ছাপিয়ে গেলে আরও দ্রুত শুকিয়ে উঠবে বিশ্বের স্থির জলরাশি, এমনটাই জানানো হচ্ছে গবেষণায়। অবশ্য শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধিই নয়, একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টিরেখার পরিবর্তন এবং মানব সভ্যতার বিকাশ ও দূষণও দায়ী এই ঘটনার পিছনে। আগামীদিনে হ্রদকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে বিশেষভাবে জলবায়ু সংরক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে প্রশাসনকে, সতর্ক করছেন গবেষকরা।
Powered by Froala Editor