করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে শোচনীয় অবস্থা দেশের। একদিকে যেমন ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতি, অন্যদিকে বেসামাল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও। তবে কি শুধুই ভাইরাসের হানা নাকি তার আগে থেকেই পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই স্বাস্থ্যে? এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে করোনার পরিস্থিতিতে। লকডাউনে উপার্জন হারিয়েছেন বহু নাগরিক। ফলে করোনা ভাইরাসের শিকার না হলেও অন্যান্য রোগের চিকিৎসা এবং খাদ্যের অভাবেই প্রাণ যাবে অসংখ্য মানুষের। এমনটাই বলছে পরিসংখ্যান।
করোনা সংক্রমণের বহুদিন আগেই দেশের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে আয়ের হিসাবে শেষ ২৫ শতাংশ মানুষের ৩৯ শতাংশ পর্যাপ্ত চিকিৎসা পান না মৃত্যুর সময়। অর্থাৎ ভারতের প্রায় ১০ শতাংশ বা ১৩ কোটি মানুষ। কারণ হিসাবে দেখা যায়, দেশে প্রতি ৫১ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পাশাপাশি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খরচ অনেকাংশেই সাধ্যের বাইরে চলে যায়। তথ্যের নিরিখে ১৪ শতাংশ পরিবারের চিকিৎসায় খরচ হয় সারা বছরের আয়। যাঁরা চিকিৎসা পান তাঁদের মধ্যেও প্রতি লাখে ১২২ জনের মৃত্যু হয় স্রেফ দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য। যে পরিসংখ্যানের নিরিখে ভারত পিচিয়ে রয়েছে ব্রাজিল, রাশিয়া, চিন, দক্ষিণ আমেরিকা এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের থেকেও।
এছাড়াও হাসপাতালের সহজলভ্যতারও চূড়ান্ত অভাব রয়েছে দেশে। প্রায় ৬৩ শতাংশ ভারতীয় বাড়ির ৫ কিলোমিটার মধ্যে কোনো হাসপাতাল পান না। জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষদের ২০১৯ এর তথ্য বলছে দেশে প্রতি দু’হাজারের বেশি মানুষের জন্য বন্দোবস্ত রয়েছে মাত্র একটি করে শয্যার। ১২টি রাজ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা এই গড়ের থেকেও আরো নিচে। প্রতি হাজার জন সাধারণ মানুষ পিছু চিকিৎসকের সংখ্যা ১.৩৪ জন। বলাই বাহুল্য করোনার পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা অসম লড়াইটাই লড়ে যাচ্ছেন।
২০১৮ সালে স্বাস্থ্য বিমা চালু করেন নরেন্দ্র মোদী। আয়ুষ্মান ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রায় ১০ কোটি ভারতীয়কে। ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্য বিমা থেকেও কি তাঁরা পরিষেবা পাচ্ছেন পর্যাপ্ত? এই প্রশ্নের সামনেই দাঁড় করাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। করোনাভাইরাসের আবহে আরও শোচনীয় অবস্থা। শুধু মার্চ-এপ্রিল এই এক মাসের তথ্যই বলছে গত বছরের তুলনায় এই বছরে ১ লক্ষ মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন ক্যানসার চিকিৎসা থেকে। সাড়ে চার লক্ষ শিশু ভ্যাকসিন পায়নি। হাসপাতালে জরুরী ব্যবস্থার সুবিধা পায়নি ৩০ শতাংশ মানুষ। উল্টোদিক দিয়ে ভাবলে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যেখানে দেশের জাতীয় আয়ের মাত্র ১ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে স্বাস্থ্যে, সেখানে এমন ছবিই তো প্রত্যাশিত।
আরও পড়ুন
‘করোনা’ ও ‘আইসোলেশন’ : মানুষ কতটা ‘একলা’?
করোনার পরিস্থিতি কেবলমাত্র আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা, স্বাস্থ্য পরিষেবার কমজোরি। তার একটা মূল কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে গ্রামীণ ভারতের পাশাপাশি জর্জরিত শহরগুলিও। ফলে মূল পরিসংখ্যান থেকেই হয়তো সরে যাই আমরা। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ডায়েরিয়া, ক্যানসার, টিবি-র কারণে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। অথচ আমাদের চোখে পেরিয়ে এসেছে সেসব, কেবলমাত্র ছোঁয়াচে নয় বলে কিংবা সংক্রমক নয় বলেই। টিউবারকিলোসিস বা টিবিতে প্রতি দিন মারা যান প্রায় ১০০০-এর বেশি মানুষ। যার প্রেক্ষিতে করোনার সংক্রমণে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা এখনও শিশু। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হতে চলেছে। কারণ চিকিৎসায় বঞ্চিত এই মানুষগুলিরই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। বা অপরদিকে এতদিন ধরে টিবি নিরামক প্রকল্পের গাফিলতিই হয়তো আরো ত্বরান্বিত করছে এই পরিস্থিতিকে। শেষ অবধি এই মহামারীর প্রকোপ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার আদৌ কি ধারণা করতে পারছি আমরা? নাকি পেরেও নিশ্চিন্ত রয়েছি এই ব্যবস্থার ওপরে। আর প্রতিনিয়ত চিকিৎসার অবহেলায় বা অপ্রতুলতায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমছে ভারতের সাধারণ মানুষের গড় কর্মক্ষমতা। যা ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে, আঘাত করছে দেশের অর্থনীতিকে। এই চক্রাবর্তের শেষ কোথায়, জানা নেই কারোর।
আরও পড়ুন
করোনার সঙ্গে দানা বাঁধছে নতুন কোনো রোগ? চাঞ্চল্য আমেরিকায়
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জন স্নো-র আবিষ্কার আর 'টাইফয়েড মেরি'র নির্বাসন - করোনার সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের পাঠ দিচ্ছে ইতিহাস